
আজকের পৃথিবীকে বলা হয় আধুনিকতার যুগ। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নতুন নতুন চিন্তার স্রোতে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনধারা। সমাজ ও সংস্কৃতির নানা রূপান্তরে মুসলমানদের মাঝেও একটি প্রশ্ন জেগেছে—ইসলাম কি এই আধুনিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, নাকি ইসলাম নিজেই আধুনিকতার পথপ্রদর্শক?
ইসলাম কেবল ধর্ম নয়, একটি জীবনব্যবস্থাও
ইসলাম শুধু নামাজ-রোজা বা কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নাম নয়। বরং এটি এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা ও অর্থনীতি—সবকিছু নিয়েই দিকনির্দেশনা দেয়।
এই ব্যাপারে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের ওপর সম্পূর্ণ করে দিলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য জীবনব্যবস্থা হিসেবে পছন্দ করলাম’ (সুরা আল-মায়িদা : ৩)। অতএব, ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়; বরং এটি সব যুগ ও পরিবেশে প্রাসঙ্গিক এক জীবনবিধান।
আধুনিক সমাজের সমস্যা এবং ইসলাম
বর্তমান সমাজে যে সমস্যাগুলো চোখে পড়ে, তার মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় অন্যতম। গীবত, গুজব, অশ্লীলতা, অন্যায়-অবিচার যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ইসলাম এসবের বিপরীতে ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা ও শালীনতার শিক্ষা দেয়।
কোরআনে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ আদেশ করেন ইনসাফ, সদাচার ও আত্মীয়কে হক দেওয়ার এবং নিষেধ করেন অশ্লীলতা, গর্হিত কাজ ও সীমালঙ্ঘন থেকে’ ( সুরা আন-নাহল : ৯০)।
আবার অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘তুমি এমন কিছুর অনুসরণ কর না, যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই’ (সুরা বনী ইসরাঈল : ৩৬)। এই আয়াতগুলো আধুনিক সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ—ভুয়া তথ্য, গুজব ও চরিত্রহননের প্রবণতার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা।
ইসলাম ও বিজ্ঞানচর্চা
অনেকেই মনে করেন, ইসলাম বুঝি বিজ্ঞানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ ইসলাম জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না—তারা কি সমান?’ (সুরা আয-যুমার : ৯)। এদিকে হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ’ (ইবনু মাজাহ : ২২৪)। এইসব দলিল থেকে বোঝা যায়, ইসলাম আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চাকে উৎসাহ দেয়, তবে তা হতে হবে আল্লাহভীতি ও নৈতিকতার আলোকে।
আধুনিক সংস্কৃতির মুখে ইসলামী মূল্যবোধ
আজকের আধুনিক সংস্কৃতিতে অনেক কিছুই ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’ বা ‘আধুনিকতা’র নামে চালানো হয়। যেমন নগ্নতা, অশ্লীলতা, গীবত, মিথ্যাচার ইত্যাদি। কিন্তু ইসলাম এসব ব্যাপারে খুবই পরিষ্কার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা নীরব থাকে’ (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)।
এই হাদিস আমাদের শেখায় কথা বলাও একটি দায়িত্ব, যা সত্য ও কল্যাণকর না হলে চুপ থাকাই শ্রেয়।
ইসলামেও আছে নবায়নের ধারণা
ইসলাম মূলনীতিগুলো অপরিবর্তনীয় রাখলেও সময়ের পরিবর্তনে বাস্তবতাকে বুঝে ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে নতুনত্ব আনতে উৎসাহ দেয়। এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতি শতাব্দীর শুরুতে আল্লাহ এমন একজনকে প্রেরণ করেন, যিনি এই উম্মতের জন্য দ্বীনকে নতুন করে তুলে ধরবেন’ (আবু দাউদ : ৪২৯১)। এটাই ‘তাজদীদ’ বা নবায়নের ধারণা, যা ইসলামের অগ্রগতিশীল চরিত্রের প্রমাণ।
পরিশেষে বলা যায়, ইসলাম ও আধুনিকতা পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়। বরং আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানকে ইসলাম সাদরে গ্রহণ করে— যদি তা নৈতিকতা ও কল্যাণের পথে ব্যবহৃত হয়। আধুনিকতার নামে অন্যায়, চরিত্রহীনতা ও বিশ্বাসহীনতা যদি সমাজে ঢুকে পড়ে, তবে ইসলাম তার সমালোচক। কিন্তু জ্ঞান, উন্নয়ন ও সময়ের প্রয়োজনে ইসলাম সব সময় মানবতার পক্ষে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মাদরাসাতুন নূর আল আরাবিয়া বাংলাদেশ, আফতাবনগর, ঢাকা।
- এটিআর