Logo

ধর্ম

নবীজির হিজরত ও আমাদের জাতির হারানো প্রকল্প

Icon

ড. আতিয়্যাহ আদলান

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ০৯:১০

নবীজির হিজরত ও আমাদের জাতির হারানো প্রকল্প

বিভিন্ন পরাশক্তির প্রকল্প যখন একে অপরকে ঠেলে সামনে আসছে, সেই টানাপড়েনে কখনো যুদ্ধ বাঁধে, কখনো শান্তি ঘোষিত হয়। কোথা থেকে বিমান উঠবে, কখন ক্ষেপণাস্ত্র গর্জে উঠবে—তা যেন ঠিক হয়ে যায় এসব প্রকল্পের ছায়ায়। এই প্রকল্পগুলোর সংঘর্ষের মাঝে পড়ে রয়েছে আমাদের উম্মাহ—একটা বিশাল দেহের মতো, যার নিথরতা দেখে বোঝা যায় না সে এখনো জীবিত নাকি বহু আগেই মৃত।

যেখানে বিভ্রান্ত ও স্বার্থান্বেষী প্রকল্পগুলো একে অপরকে ছিঁড়ে খাচ্ছে, সেখানে ঐশী দিকনির্দেশনার এই জাতি দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিহীন, লক্ষ্যহীন, প্রকল্পহীন অবস্থায়।

এই দৃশ্য কি কেবল কাকতালীয়? নাকি কোনো সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র? এমনকি নয় যে, আমাদের এমন করেই দেখতে চায় এই বিশ্বব্যবস্থা—একটি জাতি, যার আছে কিতাব, আছে নবুয়ত, কিন্তু নেই কোনো রূপরেখা, নেই কোনো স্বপ্ন, নেই কোনো কৌশল, নেই কোনো কাঠামোবদ্ধ প্রকল্প?

আমরা কি ভুলে গেছি, ইসলাম কখনো ছড়ায়নি কেবল আবেগে, বরং তা সূচিত হয়েছিল এক নির্জন উপত্যকায়, দুই পাহাড়ের মাঝখানে, সূক্ষ্ম কৌশল ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে? আমরা কি ধরে নিয়েছি, ইসলামের দাওয়াত হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিল? কোনো সুপরিকল্পনা ছাড়াই, মক্কার পাহাড়ের মাঝখানে?

এই প্রশ্নটাই যেন আজও অবিনশ্বরভাবে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে। সব চরিত্র হারিয়ে গেছে, কিন্তু প্রশ্নটি রয়ে গেছে, হিজরতের স্মরণে আমরা কি একবারও নিজেদের প্রকল্পহীনতার উত্তর খোঁজি?

হিজরতের আগে কী ঘটছিল?
হিজরতের পেছনে কেবল নিপীড়ন নয়, ছিল সুদূরপ্রসারী কৌশল। আবিসিনিয়ায় যাঁরা প্রথম হিজরত করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই ছিলেন কুরাইশের অভিজাত শ্রেণির। উসমান ইবনে আফফান, উম্মে হাবিবা, জাফর ইবনে আবি তালিব—তাঁদের ওপর মক্কার সমাজের হাত এতটা শক্ত ছিল না। অন্যদিকে, যাঁরা মক্কার অলিগলিতে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাঁরাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েননি। চাইলে তারা অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়তে পারতেন।

কিন্তু তারা মাথা নত করেন এক কালেমার প্রতি, এক আদেশের প্রতি—{كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ} ‘তোমরা তোমাদের হাত গুটিয়ে রাখো’ (সুরা আন-নিসা : ৭৭)।

তারা জানতেন, প্রথম সত্যের জন্ম চাই নীরবতা ও ভাবনার পরিবেশে—not through chaos and fire.

নবী (সা.) হিজরতের কথা তখনই ভাবলেন, যখন তিনটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে গেল
১. একটি নৈতিক ও আত্মিক শক্তিতে ভরপুর কাফেলা গড়ে উঠল, যারা পরবর্তী ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনায় সক্ষম।
২. ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস—তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত—সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হলো।
৩. শিরকভিত্তিক মানসিকতা ও চিন্তাচর্চা এমনভাবে ধ্বংস হলো, যে কাবার ভেতরে থাকা মূর্তিগুলোও তাদের জাতির চোখে মর্যাদা হারালো।

এই মঞ্চ প্রস্তুত হওয়ার পরই নবীজি (সা.) নতুন ভূমির সন্ধানে অগ্রসর হলেন। হজ মৌসুমে বিভিন্ন গোত্রকে আর কেবল ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত নয়, বরং তিনি একেবারে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কে আমাকে আশ্রয় দেবে, যাতে আমি আমার প্রভুর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি?’ এটাই ছিল দাওয়াতি কাজের একটি রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের সূচনা।

হিজরতের সময়ের কৌশল
হিজরতের সময় নবীজি নিশ্চিত ছিলেন আল্লাহর সাহায্য আসবে। তবুও কেন এত সূক্ষ্ম কৌশল?
* তিনি সরাসরি উত্তরের রাস্তা ধরে মদিনায় যাননি; বরং দক্ষিণে গুহার দিকে গিয়েছিলেন
* গুহায় কাটিয়েছেন তিন দিন।
* একজন অমুসলিম, কিন্তু বিশ্বস্ত গাইড নিয়োগ করেছেন—আবদুল্লাহ ইবন উরাইকিত।
* খাবার সরবরাহের দায়িত্ব দিয়েছেন আবু বকরের মেয়ে আসমাকে, আর সংবাদ আনার কাজ দিয়েছিলেন তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহকে।
* আলীকে (রা.) নিজের বিছানায় রেখে শত্রুদের বিভ্রান্ত করেছেন।
* এমনকি গুহার মুখে এসে দাঁড়ানো শত্রুদের উদ্দেশে বলেছেন, لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا। অর্থ : দুঃখ কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন (সুরা আত-তাওবা : ৪০)।

এ সবই একটি শক্তিশালী পাঠ। যে জাতি কেবল আবেগে ভাসে, তার পক্ষে রাষ্ট্র নির্মাণ সম্ভব নয়। প্রকৃত বিজয় আসে পরিকল্পনা ও তাওয়াক্কুলের যুগলবন্দীতে।

হিজরতের পর কী ঘটল?
যখন জাতি সঠিক পথে চলে, পরিকল্পনা অবহেলা না করে, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে—তখন আসমান থেকে সাহায্য নামে।
আল্লাহ পারস্য ও রোমকে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত করে দেন। ফলে উভয় পরাশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এদিকে বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয় লাভ করে ঠিক সেই দিনে, যেদিন রোমানরা ইরানিদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। রব্বুল আলামিন বলেনে, {وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ بِنَصْرِ اللَّهِ} ‘সেই দিন মুমিনরা আল্লাহর সাহায্যে আনন্দিত হবে’ (সুরা আর-রূম : ৪)।

এরপর শুরু হয় কূটনৈতিক দাওয়াত। নবিজি তাবুক অভিযান পরিচালনা করেন, বিভিন্ন রাজা ও নেতার কাছে দূত পাঠান। ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এই ধারার পূর্ণতা ঘটে খিলাফত ও মুসলিম বিশ্ব-অভ্যুত্থানে।

একটি প্রকল্পের গুরুত্ব
যদি প্রশ্ন করা হয়—আজকের উম্মাহ কী হারিয়েছে? উত্তর হবে, একমাত্র প্রকল্প। এই জাতির রয়েছে প্রাণবন্ত ও সাহসী যুবসমাজ। এই জাতির রয়েছে খনিজ, জ্বালানি, জল ও ভূমি। এই জাতির রয়েছে এক ওহি ও এক কিবলা। কিন্তু ঘাটতি একটিই, সংঘবদ্ধ, সমন্বিত, সুদূরপ্রসারী একটি ইসলামী প্রকল্পের। যদি মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক জোট গড়ে তোলে, আর যদি মুসলিম জনগণের মাঝে ঈমানি ভাইচারা গড়ে ওঠে—তবে তারা নিজেরাই নিজেদের জন্য যথেষ্ট হয়ে উঠবে।

উপসংহার
হিজরত ইতিহাস নয়, তা হলো বর্তমানের পাঠ। হিজরত মানে এক নতুন সূচনা—ব্যক্তিগত পরিত্রাণ নয়, বরং উম্মাহ নির্মাণের রাষ্ট্রীয় রূপরেখা। আজ আমাদের দায়িত্ব—এই হিজরতের শিক্ষাকে সামনে রেখে একটি পরিকল্পিত উত্থানের চিন্তা করা। একটি জাতিগত জাগরণের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা। হিজরতকে স্মরণ করলেই হবে না; হিজরতের চেতনায় জেগে উঠতে হবে।

অনুবাদ : ফয়জুল্লাহ আমান

  • বিএইচ/এটিআর

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম গ্রহণ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর