সুরা মারইয়াম : পবিত্র কোরআনের এই সুরা আমাদের যে শিক্ষা দেয়

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১০:৪১
-68abe96b5e25c.png)
কোরআনুল কারিম মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ দিকনির্দেশনা। প্রতিটি সুরার ভেতরেই রয়েছে নৈতিক শিক্ষা, আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা এবং জীবনযাত্রার জন্য সঠিক পথনির্দেশ। তেমনি পবিত্র কোরআনের ১৯ নাম্বার সুরা- ‘মারইয়াম’ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে আল্লাহ তাআলা কয়েকজন নবী-রাসূলের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরেছেন। এই সুরায় পাওয়া শিক্ষা শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, মানবিক জীবন গঠনের জন্যও দিকনির্দেশক।
ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি ভরসা
সুরা মারইয়ামের শুরুতে আল্লাহ তাআলা নবী জাকারিয়া (আ.)-এর দোয়া বর্ণনা করেছেন। ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক উত্তরাধিকারী দান করুন।’ (সূরা মারইয়াম, ১৯:৫) বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তবু তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় আল্লাহর কাছে উত্তরাধিকারী হিসেবে সন্তানের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। মানুষ হয়তো ভেবেছিল এটি অসম্ভব, কিন্তু আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করে ইয়াহইয়া (আ.)-কে দান করেন। এখান থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়- কোনো অবস্থায় হতাশ হওয়া যাবে না। ধৈর্য ও ভরসার সঙ্গে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে, কারণ তাঁর জন্য কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তাইতো রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দোয়া ইবাদতের মূল।’ (তিরমিজি, হাদিস ৩৩৭২)
নারীর মর্যাদা ও মারইয়ামের ত্যাগ
এই সুরার মূল চরিত্র হযরত মারইয়াম (আ.)। সমাজের কঠিন বাস্তবতায় বিবাহ ব্যতীত একা নারী হয়েও আল্লাহর নির্দেশ ও রূহের মাধ্যমে তিনি সন্তানের জন্ম দেন। সমাজের প্রশ্ন, নিন্দা, অপমান- সবকিছুর মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। কিন্তু আল্লাহ নিজেই তাঁকে সুরক্ষা দেন এবং প্রমাণ করেন, তিনি পবিত্র। কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি খাও, পান কর এবং চোখ জুড়াও। যদি কাউকে দেখ, তবে বলো- আমি পরম করুণাময়ের উদ্দেশ্যে রোজা রেখেছি, তাই আজ কারও সঙ্গে কথা বলব না।’ (সূরা মারইয়াম, ১৯:২৬) হযরত মারইয়াম (আ.) এর জীবনে আমরা নারীর মর্যাদা, সাহস ও ঈমানের শক্তি দেখতে পাই। আধুনিক সমাজেও নারীদের প্রতি সম্মান, তাদের আত্মমর্যাদা রক্ষার শিক্ষা সুরা মারইয়ামে প্রতিফলিত।
হযরত ঈসা (আ.)-এর অলৌকিক জন্ম
মারইয়ামের কোলজুড়ে জন্ম নেওয়া হযরত ঈসা (আ.) শিশু অবস্থাতেই আল্লাহর কুদরত অবলোকন করেন- তিনি দোলনা থেকেই কথা বলা শুরু করেছিলেন। মায়ের পক্ষ থেকে তিনি মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন।’ (সূরা মারইয়াম, ১৯:৩০) এখান থেকে একটি বড় শিক্ষা হলো, আল্লাহ চাইলে তাঁর কুদরতের মাধ্যমে যেকোনো ঘটনা ঘটাতে পারেন। একইসঙ্গে এই ঘটনা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আল্লাহর ইচ্ছার ফল।
পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব
সুরা মারইয়ামে শুধু নবীদের জীবনকথা নয়, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতার কথাও উঠে এসেছে। হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর কাহিনিতে দেখা যায় তিনি কিভাবে পিতা আজারের ভুল ধারণা সংশোধন করার চেষ্টা করেছিলেন। আবার পিতা যখন সত্যের বিরোধিতা করেন, তখন আল্লাহর পথে অটল থাকার শিক্ষা দিয়েছেন ইবরাহিম। তিনি তাঁর পিতাকে বলেছিলেন, ‘হে আমার পিতা! এমন কিছুর উপাসনা করো না যা শোনে না, দেখে না এবং তোমার কোনো কাজে আসবে না।’ (সূরা মারইয়াম, ১৯:৪২) তবে বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি শিষ্টাচার বজায় রাখেন। রাসুল (সা.)-ও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (বুখারি, হাদিস ৫৯৮৮) এর মাধ্যমে শেখানো হয়েছে- সত্য ও ঈমানের প্রশ্নে আপস নয়।
আখিরাতের কথা স্মরণ
এই সুরায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। মানুষের সব অর্জন, অহংকার, সম্পদ- কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। যেদিন আখিরাতের দিন আসবে, সেদিন কেবল ঈমান ও সৎকর্মই কাজে আসবে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি কিয়ামতের দিন মুজরিমদের জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাব।’ (সূরা মারইয়াম, ১৯:৮৬) এছাড়া রাসুল (সা.) সতর্ক করে বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়।’ (তিরমিজি, হাদিস ২৪৫৯) মূলত এই স্মরণ মানুষের জীবনকে সৎ পথে পরিচালিত করে।
পবিত্র কোরআনের মূল শিক্ষা
সুরা মারইয়ামে বারবার দয়া, করুণা ও আল্লাহর রহমতের কথা বলা হয়েছে। নাম থেকেই বোঝা যায়, এ সুরা ভালোবাসা, স্নেহ আর ত্যাগের প্রতীক। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতিপালকের দয়া তাঁর নির্বাচিত বান্দাদের ওপর অতি নিকটবর্তী।’ (সূরা মারইয়াম, ১৯:৫০) নবীদের জীবনের নানা ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ দেখিয়েছেন- মানুষের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো বিশ্বাস, ধৈর্য, এবং মানবিক গুণাবলি।
সমকালীন তাৎপর্য
আজকের সমাজে আমরা নানা সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি- হতাশা, মূল্যবোধের সংকট, পারিবারিক ভাঙন ও নারীর প্রতি অবিচার। সুরা মারইয়ামের শিক্ষা আমাদের এসব সমস্যা সমাধানে পথ দেখায়। এখানে শিখানো হয়েছে আশা না হারাতে, নারীর মর্যাদা রক্ষা করতে, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হতে এবং আখিরাতের কথা মনে রেখে সৎ পথে চলতে।
সুতরাং, সুরা মারইয়াম জীবনের জন্য বাস্তব দিকনির্দেশনা। নবীদের জীবনী আমাদের শেখায়, প্রতিটি পরীক্ষা আসলে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি শিক্ষা। বিশ্বাস, ধৈর্য, মানবিকতা ও ন্যায়ের পক্ষে অটল থাকা- এগুলোই সুরা মারইয়ামের প্রধান বার্তা। এই শিক্ষা অনুসরণ করলেই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
আইএইচ/