Logo

ধর্ম

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রেরিত চিঠিপত্রের ইতিহাস

Icon

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:৫৭

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রেরিত চিঠিপত্রের ইতিহাস

আজ বিশ্ব চিঠি দিবস। চিঠির আদান-প্রদান শুধু যে অনুভূতি বা খবর পৌঁছানোর বাহক এমন নয়, ইতিহাসে এটি ছিল জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিস্তারের মাধ্যম। মানবতার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-ও চিঠিকে দ্বীনের দাওয়াতের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। প্রেরিত চিঠিতে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মানুষকে শরিয়তের বিধি-বিধান শিক্ষা দিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর প্রেরিত চিঠিগুলোও ছিল দ্বীন প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

উম্মি নবী ও লেখক সাহাবিগণ

নবীজি (সা.) নিজে লিখতে জানতেন না। তিনি ছিলেন উম্মি বা অক্ষরজ্ঞানহীন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই উম্মিদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে আবৃত্তি করে তাঁর আয়াতগুলো, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত; এর আগে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।’ (সুরা জুমা : ২)

উম্মি হলেও নবীজি (সা.)-এর জন্য বহু সাহাবি লিখতেন। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওজি (রহ.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী- হযরত আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী, জুবায়ের ইবনুল আওয়াম, উবাই বিন কাআব, মুয়াবিয়া, জায়েদ বিন সাবিত (রা.)-সহ আরও অনেকে তাঁর চিঠি ও ওহি লিপিবদ্ধ করতেন। (জাদুল মাআদ : ১/১১৭)

কতগুলো চিঠি প্রেরণ করেছিলেন 

সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না গেলেও মিশরীয় ইতিহাসবীদ ড. হামিদুল্লাহর মতে, নবীজি (সা.) ২০০ থেকে ২৫০ জনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ১০ জন সম্রাট ও ৫ জন আঞ্চলিক প্রশাসকের উদ্দেশে লেখা চিঠির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। 

সিলমোহর ও চিঠির মর্যাদা

রাষ্ট্রীয় কাজে নবীজি (সা.) একটি রুপার আংটিকে সিলমোহর হিসেবে ব্যবহার করতেন। তাতে লেখা ছিল, উপরে আল্লাহ, তার নিচে রাসুল, এবং সবচেয়ে নিচে মুহাম্মদ। নিচ থেকে পড়লে হয়: ‘মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ’। যা তাঁর পরবর্তী দুই খলিফা আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.) ব্যবহার করেছিলেন। অতঃপর উসমান এর সময় তা হারিয়ে যায়।

এ ব্যাপারে আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আংটি ছিল রুপার তৈরি এবং তাঁর নাগিনাও ছিল রুপার। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৮৭০)

পত্রবাহকরা ছিলেন যোগ্য প্রতিনিধি

সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) পত্রবাহকদের সম্পর্কে এভাবে লিখেছেন, “রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক সম্রাটের জন্য এমন দূত প্রেরণ করতেন, যারা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বুঝতেন এবং সম্মান অনুযায়ী কথা বলতে পারতেন।” (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ২৮৮)

চিঠি যাদের উদ্দেশে লেখা হয়েছিল

চিঠিগুলো সাধারণত ৫ শ্রেণির মানুষের উদ্দেশে লেখা হয়েছিল-

এক. সাধারণ সাহাবি : রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো কখনো সাধারণ সাহাবিদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছেন। যেসব চিঠিতে তিনি তাঁদের প্রয়োজনীয় উপদেশ দান করেছেন বা শরিয়তের কোনো বিধান বর্ণনা করেছেন। যেমন- মুয়াজ (রা.)-এর ছেলে মারা গেলে নবীজি (সা.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি তাঁকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেন এবং তাঁর জন্য উত্তম প্রতিদানের দোয়া করেন। (হুলয়াতুল আউলিয়া : ১/২৪৩)

দুই. প্রশাসক সাহাবি : রাসুলুল্লাহ (সা.) যেসব সাহাবিকে বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশেও কখনো কখনো চিঠি লিখেছিলেন। মুনজির বিন সাবি বিন আখনাস (রা.), যিনি বাহরাইন অঞ্চলের শাসক ছিলেন, তিনি নবীজি (সা.)-এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর গোত্রের যারা ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে তা জানতে চান। নবীজি (সা.) চিঠির উত্তরে লেখেন, যারা কালেমায় বিশ্বাসী ও মুসলমানদের কিবলার অনুসারী তাদের মুসলিম হিসেবে গণ্য করে নিতে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৬/৪২৭)

তিন. গোত্র বা সম্প্রদায় : ইবনুল কায়্যিম জাওজি (রহ.) রাসুলুল্লাহ (সা.) ইয়ামানবাসীর উদ্দেশে এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন। চিঠিতে জাকাত, দিয়ত, কবিরা গুনাহ, তালাক, দাসমুক্তি, একই কাপড়ে নামাজ আদায়, কোরআন স্পর্শ করা ইত্যাদি বিষয়ের বিধান বর্ণিত হয়েছিল। (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা ৭৬)

চার. গোত্রপ্রধান ও আঞ্চলিক প্রশাসক : নবীজি (সা.) একাধিক গোত্রপ্রধান ও আঞ্চলিক প্রশাসকের উদ্দেশে চিঠি লেখেন। যেমন- 

১. বনু হানিফ গোত্রের সরদার হাওজা বিন আলী হানাফির কাছে সালিত বিন আমর আমেরি (রা.)-এর মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হয়। হাওজা পারস্য সম্রাট কিসরার পক্ষ থেকে নজদের ইয়ামামা শাসন করতেন।

২. ওমানে বসবাসকারী জাহরান গোত্রের দুই নেতা জায়ফা ও আবদের কাছে আমর ইবনুল আস (রা.)-এর মাধ্যমে চিঠি পাঠান। তাঁরা ছিলেন জালান্দারের দুই ছেলে।

৩. আলা ইবনে হাদরামি (রা.)-এর মাধ্যমে মুনজির বিন সাবি বিন আখনাস (রা.)-এর কাছে চিঠি পাঠান। যিনি বাহরাইন অঞ্চলের শাসক ছিলেন এবং নবীজি (সা.)-এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণ করেন।

৪. মুহাজির ইবনে উমাইয়া মাখজুমি (রা.)-এর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হারেস ইবনে আবদে কিলাল হিময়ারি (রহ.)-এর কাছে পত্র পাঠান। তিনি নবীজি (সা.)-এর আহ্বানে ইসলাম গ্রহণ করেন।

৫. ইয়েমেনের অপর দুই প্রভাবশালী নেতা জুলকিলা ও জুলআমরের কাছেও নবীজি (সা.) চিঠি পাঠান। তাঁদের কাছে চিঠি নিয়ে যান জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৩৬৫-৩৬৯)

পাঁচ. রাজা ও সম্রাট : প্রায় ১০ জন রাজা, বাদশাহ ও শাসকের কাছে ইসলামের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন। যেমন- 

১. দিহয়াতুল কালবি (রা.)-এর মাধ্যমে রোম সম্রাট কায়সারের কাছে চিঠি পাঠান।

২. আবদুল্লাহ ইবনে হুজাফা সাহমি (রা.)-এর মাধ্যমে পারস্য সম্রাট কিসরার কাছে পত্র পাঠান।

৩. আমর বিন উমাইয়াম দামেরি (রা.)-এর মাধ্যমে হাবশার বাদশাহ নাজ্জাসির কাছে পত্র পাঠান।

৪. হাতেব ইবনে আবি বালতাআ (রা.)-এর মাধ্যমে ইস্কান্দারিয়ার (মিসর) শাসক মুকাওকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন।

৫. সালিত ইবনে আমর (রা.)-এর মাধ্যমে ইয়ামার শাসক সুমামা বিন উসালের কাছে পত্র পাঠান।

৬. সুজা বিন ওয়াহাব আসদি (রা.)-এর মাধ্যমে শামের শাসক হারিস বিন আবি শামার গাসসানির কাছে পত্র পাঠান।

৭. হারেস বিন উমায়ের আজদি (রা.)-এর মাধ্যমে বসরার শাসকের কাছে পত্র প্রেরণ করেন।

৮. মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)-এর মাধ্যমে ইয়েমেনের শাসক আবদে কিলালের তিন ছেলে হারিস, শুরাহবিল ও নুআইমের কাছে পত্র প্রেরণ করেন। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৩৬৫-৩৬৯; আস সিরাতুন নাবাবিয়্য লি-ইবনে হিশাম : ৪/৮০৯)

ফলাফল ও প্রভাব

এসব চিঠির মূল বিষয়বস্তু ছিল তাওহিদ ও রিসালাতের প্রতি আহ্বান। যেন এর মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে বিশ্বময় পৌঁছে যায়। পৃথিবীতে ইসলাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং নবীজি (সা.)-এর পরিচিতি বিস্তার লাভ করে। (আর রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৩৬৯)

আজ বিশ্ব চিঠি দিবসে যখন আমরা চিঠির ইতিহাস নিয়ে ভাবি, তখন মনে রাখা উচিত- চিঠিই একসময় ইসলামের দাওয়াতের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যমগুলোর একটি ছিল। মহানবী (সা.)-এর পাঠানো প্রতিটি চিঠি শুধু যে ইতিহাসের দলিল ব্যাপারটি এমন নয়, বরং এটি দাওয়াতি প্রজ্ঞার অসাধারণ এক নিদর্শন।

আইএইচ/

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর