-68b9009c0f881.png)
মানুষ পার্থিব জীবনে বিভিন্ন প্রয়োজনে অন্যের সাথে কথা বলে। মুখ বন্ধ করে সমাজে বসবাস করা সম্ভব নয়। নিজের প্রয়োজন প্রকাশের জন্য যেমন কথা বলা জরুরি, তেমনি অন্যের প্রয়োজন পূরণের জন্যও কথোপকথন অপরিহার্য। তবে কথা বলার ক্ষেত্রেও মুমিনকে কিছু আদব বা শিষ্টাচার মেনে চলতে হয়। ইসলাম শেখায়- বিনা প্রয়োজনে নীরব থাকা যেমন ভালো, তেমনি প্রয়োজনের সময় চুপ থাকাও অনুচিত। বরং ইসলামের আলোকে সুন্দর, শালীন ও উপকারী কথাবার্তা বলাই একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য। নিম্নে রাসূলের হাদিস ও কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী কথোপকথনের কিছু মৌলিক আদব উল্লেখ করা হলো-
১. কথাবার্তা উত্তম বিষয়ে হওয়া
মানুষের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত হয় (সূরা ক্বাফ ৫০:১৮)। তাই সর্বদা উত্তম কথা বলা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা নীরব থাকে।’ (বুখারি, মুসলিম)
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো- অর্ধেক খেজুর দান করে হলেও। যদি তা-ও না পাও, তবে অন্তত একটি উত্তম কথা বলো।’ (বুখারি, মুসলিম)
অসংযত কথার কারণেই মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (তিরমিজি, ইবন মাজাহ)। আল্লাহও বলেন, ‘তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোনো কল্যাণ নেই; তবে যে ব্যক্তি সদকা, সৎকাজ বা মানুষের মধ্যে সন্ধি স্থাপনে উৎসাহ দেয় এবং যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তা করে- তাকে আমি মহা পুরস্কার দেব।’ (সূরা নিসা ৪:১১৪)
২. শোনা যায় এমন কণ্ঠে কথা বলা
কথা এমনভাবে বলা উচিত, যা অপরজন স্পষ্ট শুনতে পায়; আবার উচ্চস্বরে চিৎকার করাও অনুচিত। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু কর। নিশ্চয়ই সবচেয়ে নিকৃষ্ট শব্দ হলো গাধার ডাক।’ (সূরা লোকমান ৩১:১৯)
৩. অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় কথা বর্জন
অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন কথা পরিহার করা ইসলামের সৌন্দর্য। নবী (সা.) বলেন, ‘মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য হলো- সে অনর্থক কথাবার্তা বর্জন করে।’ (তিরমিজি ২৩১৮, ইবন মাজাহ ৩৯৭৬)
এমনকি মানুষ কখনো এমন কথা বলে বসে, যা আল্লাহর গজব ডেকে আনে, অথচ সে গুরুত্বই দেয় না। কিন্তু সেই কথার কারণে সে ৭০ বছর জাহান্নামে পতিত থাকবে। (তিরমিজি ২৩১৪)।
৪. যাচাই ছাড়া শোনা কথা প্রচার না করা
গুজব ও যাচাই-বাছাইহীন সংবাদ প্রচার মিথ্যার পর্যায়ে পড়ে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যা শুনে তাই বলে বেড়ায়, তার পাপী হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।’ (মুসলিম ৫)
আরেক বর্ণনায় আছে, ‘যা শুনে তাই বলে বেড়ানোই মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (আবু দাউদ ৪৯৯২)
৫. অপ্রয়োজনীয় তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলা
তর্ক বা ঝগড়া কখনো কল্যাণ বয়ে আনে না। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সত্যের উপর থেকেও তর্ক বর্জন করে, আমি তার জন্য জান্নাতের প্রান্তে একটি ঘরের জামিন হচ্ছি। যে ব্যক্তি মিথ্যা বর্জন করে, আমি তার জন্য জান্নাতের মাঝখানে একটি ঘরের জামিন। আর যে ব্যক্তি উত্তম চরিত্র অর্জন করে, তার জন্য আমি জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে একটি ঘরের জামিন।’ (আবু দাউদ ৪৮০০, তিরমিজি ১৯৯৩)
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘হেদায়াতপ্রাপ্ত হওয়ার পর কোনো কওম পথভ্রষ্ট হয়নি, যতক্ষণ না তারা তর্কে লিপ্ত হয়েছে।’ (তিরমিজি ৩২৫৩)
৬. ধীরে ও স্পষ্টভাবে কথা বলা
আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসূল (সা.) এত স্পষ্টভাবে কথা বলতেন যে, কেউ চাইলে তাঁর প্রতিটি শব্দ গুনে নিতে পারত।’ (বুখারি ৩৫৬৮, মুসলিম ২৪৯৩)
আনাস (রা.) বলেন, ‘নবী কোনো কথা বললে তা তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন, যাতে শ্রোতা ভালোভাবে বুঝতে পারে।’ (বুখারি ৯৫)
৭. অশ্লীলতা ও কটুভাষা বর্জন
রাসূল (সা.) বলেন, ‘মুমিন কখনো অভিসম্পাতকারী, কটূভাষী বা অশ্লীল হতে পারে না।’ (তিরমিজি ১৯৭৭)
৮. বাচালতা ও অহংকারী ভঙ্গি পরিহার
অতিরিক্ত কথা বলা, অহংকারপূর্ণ বা জটিল ভঙ্গিতে কথা বলা ইসলামে নিন্দিত। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে চরিত্রে উত্তম লোক আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং কিয়ামতের দিনও আমার নিকটে প্রিয় থাকবে। আর যারা বাচাল, দাম্ভিক এবং অহংকারী- তারা আমার নিকট থেকে সবচেয়ে দূরে থাকবে।’ (তিরমিজি ২০১৮)
৯. গীবত ও চোগলখোরি থেকে বিরত থাকা
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কেউ কারো গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পছন্দ করবে? অবশ্যই তোমরা তা অপছন্দ করবে।’ (সূরা হুজুরাত ৪৯:১২)
চোগলখোরি সম্পর্কেও সতর্ক করেছেন নবী ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি ৬০৫৬, মুসলিম ১০৫)
১০. মনোযোগ দিয়ে শোনা ও অন্যকে সুযোগ দেওয়া
মজলিসে অন্যকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া এবং মনোযোগ দিয়ে শোনা আদবের অংশ। রাসূল (সা.) বলেন, ‘বড়কে আগে কথা বলতে দাও।’ (বুখারি ২৪১০, মুসলিম ১৬৬৯)
১১. নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন
কঠোরতা মানুষের মন জয় করতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের প্রতি কোমল হয়েছিলে। যদি তুমি কঠোর ও রূঢ় হতে, তবে তারা তোমার পাশ থেকে সরে যেত।’ (সূরা আলে ইমরান ৩:১৫৯)
১২. ঠাট্টা-বিদ্রূপ এড়িয়ে চলা
অন্যকে উপহাস বা হেয় করা ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! কোনো সম্প্রদায় যেন অপর সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। হতে পারে তারা তাদের চেয়ে উত্তম।’
(সূরা হুজুরাত ৪৯:১১)
১৩. তিনজনের মাঝে দু’জন গোপনে কথা না বলা
রাসূল বলেন, ‘তোমরা তিনজন একত্র হলে, দু’জন যেন তৃতীয়জনকে বাদ দিয়ে গোপনে কথা না বলে। এতে সে দুঃখিত হয়।’ (বুখারি ৬২৮৮, মুসলিম ২১৮৪)
১৪. আমানত রক্ষা করা
কোনো কথা যদি আমানত হিসেবে বলা হয় তবে তা ফাঁস করা জায়েজ নয়। নবী (সা.) বলেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারিত্ব নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই।’ (মুসনাদ আহমাদ ১২৫৬৫)
১৫. জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করা
নবী (সা.) বলেন, ‘বান্দার ঈমান সঠিক হয় না যতক্ষণ না তার অন্তর সঠিক হয়, আর অন্তর সঠিক হয় না যতক্ষণ না তার জিহ্বা সঠিক হয়।’ (মুসনাদ আহমাদ ১২৬৩৬)
তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠলে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জিহ্বাকে বলে- তুমি যদি সোজা পথে থাক, আমরাও সোজা পথে থাকব; তুমি যদি বাঁকা পথে যাও, আমরাও বাঁকা পথে যাব।’ (তিরমিজি ২৪০৭)
সুতরাং, ইসলামী আদব অনুযায়ী কথাবার্তা বলা একজন মুমিনের পরিচয়। সুন্দর ও শালীন বাকভঙ্গি মানুষকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জনে সাহায্য করে এবং পরকালে অশেষ সওয়াবের কারণ হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কথোপকথনে ইসলামের শিষ্টাচার মেনে চলার তাওফিক দান করুন, আমিন।