ভোট একটি আমানত, ভোটারের জন্য ইসলামে যে বিধান রয়েছে
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৯

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন বাংলাদেশের ছাত্র-রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। দীর্ঘদিন পর আজ মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে ডাকসু নির্বাচন শুরু হয়েছে। এই নির্বাচন কে ঘিরে শুধু রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠন নয়; দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে যারা ভোটার, তাদের ভোটের মাধ্যমেই নেতৃত্ব বাছাই হবে। তবে একজন ভোটার হিসেবে ভোট দেওয়া শুধুমাত্র সাংবিধানিক বা গণতান্ত্রিক দায়িত্বই নয়, বরং এটি আমানত, ইবাদত এবং বিশাল জবাবদিহিমূলক কাজ। ভোট দেওয়া মানে হচ্ছে সৎ, যোগ্য, আমানতদার ও খোদাভীরু ব্যক্তিকে দায়িত্ব অর্পণ করা।
আর ইসলাম যেহেতু একটি সর্বকালীন, সার্বজনীন পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানবজীবনের যাবতীয় সমস্যার দিকনির্দেশনা ইসলামে বিদ্যমান। এই ধর্মে কেবল আখেরাতের দিকনির্দেশনা রয়েছে এমন নয়, বরং দুনিয়ার সব বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি দিয়েছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, রাজনীতি- মানবজীবনের প্রতিটি সমস্যার সমাধান ইসলামে বিদ্যমান। নেতৃত্ব ও নির্বাচন প্রসঙ্গেও কুরআন-হাদিসে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। নবীজির (সা.) ইন্তেকালের পর যখন সাহাবায়ে কেরাম রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনকে দাফন-কাফনের চেয়েও অগ্রাধিকার দিলেন, তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচন ইসলামে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামে ভোট একটি আমানত
ভোট মূলত তিনটি বিষয়ের সমষ্টি- ১. সাক্ষ্য প্রদান করা, ২. সুপারিশ করা, ৩. প্রতিনিধির ক্ষমতা প্রদান করা।
সাক্ষ্য দেওয়া : যাকে ভোট দেওয়া হলো, তার যোগ্যতা ও সততার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়া হলো। অসৎ বা অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার অর্থ হচ্ছে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, যা ইসলামে মহাপাপ। আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদাররা, তোমরা আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য প্রদানে ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যদি তা তোমাদের নিজেদের কিংবা পিতা-মাতা অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়। যদি সে বিত্তশালী হয় কিংবা দরিদ্র হয়। তবে আল্লাহ উভয়ের ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা (প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে) এড়িয়ে যাও, তবে জেনে রেখো তোমরা যা করো, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত’। (সূরা: নিসা, আয়াত-১৩৫)।
সুপারিশ করা : ভোট মানে প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুপারিশ করা। যদি সৎ প্রার্থী হয়, ভোটদাতা তার সওয়াবে শরিক হবে; আর অসৎ প্রার্থী হলে তার গুনাহেও শরিক হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি সৎকাজের জন্য কোনো সুপারিশ করবে তা থেকে (সৎ কাজের) একটি অংশ পাবে। আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজের সুপারিশ করবে, সে তার (মন্দ কাজের) একটি অংশ পাবে। আর আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ের সংরক্ষণকারী’। (সূরা: নিসা, আয়াত-৮৫)।
ক্ষমতা অর্পণ করা : ভোট মানে প্রার্থীর হাতে নেতৃত্বের ক্ষমতা তুলে দেওয়া। অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থীকে ক্ষমতা দিলে তার অপকর্মের দায় ভোটারদের ওপরও বর্তাবে।
এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এ (মানুষের জীবন পরিচালনায় ইসলামের বিধিবিধান পালনের) আমানত পেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা তাতে আশঙ্কিত হলো, কিন্তু মানুষ সে দায়িত্বভার গ্রহণ করল। সে বড়ই অন্যায়কারী, বড়ই অজ্ঞ’। (সূরা: আহযাব, আয়াত-৭২)।
হাদিসের আলোকে ভোটের গুরুত্ব
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করার মতো বড় গুনাহ।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২২৯৯)
‘যে ভালো কাজে সুপারিশ করবে সে তার সওয়াবে শরিক হবে, আর যে মন্দ কাজে সুপারিশ করবে সে তার গুনাহে শরিক হবে।’ (তিরমিজি, মিশকাত)
‘প্রত্যেক কাজ নিয়তের ওপর নির্ভর করে।’ (বুখারি-মুসলিম)
অতএব, আজকের ডাকসু নির্বাচন কেবলই রাজনৈতিক কাজ নয়, বরং এটি ইসলামের দৃষ্টিতে আমানত রক্ষা ও ন্যায় সাক্ষ্য প্রদানের অংশ।
আর একজন ভোটারের দায়িত্ব হলো- সৎ, যোগ্য, আমানতদার, ন্যায়পরায়ণ প্রার্থীকে ভোট দেওয়া। অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকা। প্রার্থীর ব্যক্তিগত জীবন, চারিত্রিক যোগ্যতা, খোদাভীতি ও ছাত্রসমাজের কল্যাণে তার ভুমিকা যাচাই করা। কোনো প্রভাব, অর্থ বা স্বার্থের কারণে অযোগ্য প্রার্থীকে ভোট না দেওয়া।
ডাকসু নির্বাচন আগামী প্রজন্মের চিন্তাধারা ও জাতীয় নেতৃত্বের ভিত গড়ে দেবে। একজন ভোটারের উচিত বুঝে-শুনে, খোদাভীতি নিয়ে এবং আমানতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভোট প্রদান করা। কারণ, ভোট হচ্ছে সাক্ষ্য, সুপারিশ ও ক্ষমতা অর্পণ- যা আল্লাহর কাছে জবাবদিহির বিষয়। সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের মাধ্যমে যেমন উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হবে, তেমনি অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থী নির্বাচিত হলে এর দায়-ভার ভোটারদের ওপরও বর্তাবে।
আইএইচ/