Logo

ধর্ম

সুরা ইয়াসিনের গুরুত্ব ও ফজিলত

Icon

মুফতি খায়রুল হাসান বিন মুজাহিদ

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩০

সুরা ইয়াসিনের গুরুত্ব ও ফজিলত

পবিত্র কুরআনের প্রতিটি সুরাই রহমত, হিদায়াত ও কল্যাণে পরিপূর্ণ। তবে কিছু সুরায় এমন বিশেষ মর্যাদা ও প্রভাব বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো সুরা ইয়াসিন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ইয়াসিন’ শব্দের অর্থ বনী তায়ি গোত্রের ভাষায় ‘হে মানুষ’। আর ইবনে হানিফিয়্যাহ (রহ.) বলেন, এর অর্থ ‘হে মুহাম্মদ (সা.)’। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমাকে কুরআনে সাতটি নামে ডাকা হয়েছে। সেগুলো হলো- মুহাম্মদ, আহমদ, ত্বাহা, ইয়াসীন, আল-মুজ্জাম্মিল, আল-মুদ্দাসির এবং আবদুল্লাহ’। 

সুরা ইয়াসিন কুরআনের ৩৬তম সূরা, এতে রয়েছে ৮৩টি আয়াত। এটি মক্কায় অবতীর্ণ এবং এর মূল বিষয়বস্তু হলো আল্লাহর একত্ব, নবুওয়াত, পুনরুত্থান ও আখিরাতের জবাবদিহিতা। মুসলমানদের কাছে এটি ‘কুরআনের হৃদয়’ হিসেবে পরিচিত, কারণ এর তেলাওয়াতে হৃদয় প্রশান্ত হয়, চিন্তায় স্বচ্ছতা আসে এবং আমলে দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়। এই সূরা পাঠ করলে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভ করে। মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির কাছে এটি পাঠ করলে মৃত্যু সহজ হয়, আর জীবিত ব্যক্তি পাঠ করলে আল্লাহ তার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে, ‘প্রতিটি জিনিসের একটি অন্তর আছে, আর কুরআনের অন্তর হলো সুরা ইয়াসিন। যে ব্যক্তি ইয়াসিন পাঠ করে, আল্লাহ তাকে পুরো কুরআন দশবার পাঠ করার সমান সওয়াব দেন।’ (তিরমিজি: ২৮৮৭) যদিও এই হাদীস ‘দুর্বল’ ধরণের, তবু ফজায়েলের ক্ষেত্রে তা গ্রহণযোগ্য এবং এটি সুরা ইয়াসিনের মর্যাদা প্রকাশ করে।

তাফসিরে মারেফুল কোরআনে আছে, ইমাম গাযালী (রহ.) বলেন, সুরা ইয়াসিনকে কুরআনের হৃৎপিণ্ড বলার কারণ হতে পারে, এতে কিয়ামত, হাশর-নশর ও আখিরাতের বাস্তবতা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। পরকাল বিশ্বাস ঈমানের এমন একটি মৌলিক স্তম্ভ, যার উপর মানুষের আমল ও নৈতিকতার বিশুদ্ধতা নির্ভরশীল। পরকালভীতিই মানুষকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে এবং হারাম কাজ থেকে দূরে রাখে। যেমন দেহের সুস্থতা অন্তরের সুস্থতার উপর নির্ভরশীল, তেমনি ঈমানের দৃঢ়তা নির্ভর করে পরকাল চিন্তার উপর।

‘রূহুল মা’আনী’ তাফসিরে উল্লেখ আছে, এ সূরার নাম যেমন ‘ইয়াসিন’ প্রসিদ্ধ, তেমন এক হাদীসে এর নাম ‘আযীমা’ বলা হয়েছে। আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, তাওরাতে এর নাম ‘মুয়িম্মাহ্’, অর্থাৎ এ সূরা তার পাঠকের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও বরকত বৃদ্ধি করে। এর পাঠকের নাম ‘শরীফ’ বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন এর সুপারিশ ‘রবীয়া’ গোত্রের চেয়েও বেশি মানুষের জন্য কবুল হবে। কিছু রেওয়ায়েতে এর নাম ‘মুদাফিয়া’ বলা হয়েছে— অর্থাৎ এ সূরা পাঠকদের বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করে। আবার কিছু বর্ণনায় এর নাম ‘কাযিয়া’ বলা হয়েছে— অর্থাৎ এটি পাঠকের প্রয়োজন পূরণ করে।

হযরত আবু যর (রা.) বলেন, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির কাছে সূরা ইয়াসীন পাঠ করলে তার মৃত্যু সহজ হয় (মাযহারী)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) বলেন, কেউ অভাব-অনটনের সময় সূরা ইয়াসীন পাঠ করলে আল্লাহ তার অভাব পূর্ণ করে দেন (মাযহারী)। ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর বলেন, যে ব্যক্তি সকালে সুরা ইয়াসিন পাঠ করবে, সে সন্ধ্যা পর্যন্ত শান্তিতে থাকবে, আর যে সন্ধ্যায় পাঠ করবে, সে সকাল পর্যন্ত স্বস্তিতে থাকবে। তিনি আরও বলেন, ‘এ কথা আমাকে এমন একজন বলেছেন, যিনি নিজে এর বাস্তব অভিজ্ঞতা পেয়েছেন।’ (মাযহারী)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের মৃতদের উপর সুরা ইয়াসিন পাঠ করো।’ (আবু দাউদ: ৩১২১)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে-  ‘সূরা ইয়াসীন হলো কুরআনের হৃদয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকাল অর্জনের উদ্দেশ্যে এটি পাঠ করে, তার গুনাহ মাফ করা হয়। তাই তোমরা তোমাদের মৃতদের উপর এটি পাঠ করো।’

আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাতে সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াত করে, তার গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (ইবনু হিব্বান: ২৫৭৪) এতে বোঝা যায়, নিয়মিত পাঠের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার কষ্ট দূর করেন এবং আখিরাতে ক্ষমা দান করেন।

আরও একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সূরা ইয়াসীন তাওরাতে ‘আল-মু‘ইম্মাহ’ নামে পরিচিত, কারণ এটি তার পাঠককে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণে আচ্ছাদিত করে রাখে। এটি দুনিয়ার বিপদ-আপদ দূর করে এবং আখিরাতের ভয়াবহতা থেকেও রক্ষা করে।’ (আল-বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান: ২৪৬৫)।

সবশেষে বলা যায়, সুরা ইয়াসিন শুধুমাত্র তেলাওয়াতের জন্য নয়, বরং তা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রহমত, প্রশান্তি ও কল্যাণের উৎস। এর পাঠ হৃদয়ে ঈমান দৃঢ় করে, আল্লাহর প্রতি ভরসা বাড়ায় এবং মানুষকে আখিরাতের প্রস্তুতিতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সুরা ইয়াসিনের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝে নিয়মিত তেলাওয়াতের তাওফিক দিন এবং এর বরকতে আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়কে কল্যাণময় করুন, আমীন।

লেখক : মুহাদ্দিস ও সিনিয়র শিক্ষক সাতগাঁও মাদ্রাসা বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর