Logo

ধর্ম

সুদখোরদের জন্য আল্লাহ যে ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন

Icon

মুফতি খায়রুল হাসান বিন মুজাহিদ

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:১৮

সুদখোরদের জন্য আল্লাহ যে ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি দিককে সঠিক পথে পরিচালনা করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইসলাম ন্যায়, সহানুভূতি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার উপর গুরুত্ব দেয়। কিন্তু আজকের সমাজে এমন একটি পাপ রয়েছে যা অর্থনীতি, নৈতিকতা ও ঈমান—সবকিছুকে ধ্বংস করছে, আর সেটি হলো সুদ (রিবা)।

সুদ এমন এক মারাত্মক অন্যায়, যা আল্লাহ তাআলা কুরআনে কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছেন এবং তাঁর রাসূল (সা.) একে মহাপাপের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। 

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা সুদ খায়, তারা সেই ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দিয়েছে। কারণ তারা বলে, ‘বাণিজ্য তো সুদের মতোই।’ অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।”(সূরা আল-বাকারা: ২৭৫)

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “আল্লাহ সুদের মাধ্যমে সম্পদ ধ্বংস করেন এবং দান-সদকার মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি করেন। আর আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ ও গোনাহগারকে ভালোবাসেন না।”( সূরা আল-বাকারা: ২৭৬)

আল্লাহ তাআলা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে অংশ বাকি আছে তা ত্যাগ কর, যদি তোমরা সত্যিকার অর্থে মুমিন হও। আর যদি তা না কর, তবে জেনে রাখ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা পেয়ে গেছো।” (সূরা আল-বাকারা: ২৭৮–২৭৯)

এছাড়া আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি তার প্রভুর উপদেশ পেয়ে সুদ থেকে বিরত থাকে, তার পূর্বেকার যা কিছু হয়েছে তা ক্ষমা করা হবে। কিন্তু যে পুনরায় ফিরে যায়, তারা জাহান্নামের অধিবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।”( সূরা আল-বাকারা: ২৭৫)

কুরআনের এই ঘোষণাগুলো প্রমাণ করে, সুদ এমন এক অপরাধ যা আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করার সমান। এটি কেবল সম্পদ নষ্টই করে না, বরং সমাজে অন্যায়, বৈষম্য ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “সুদখোর, সুদদাতা, সাক্ষী এবং লেখক- এ চারজনের উপরই আল্লাহর লানত।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৫৯৮)

আরেকটি হাদীসে তিনি বলেন, “সুদ হচ্ছে তেহাত্তরটি দরজা (ধরন)। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি হলো, যেন কেউ তার নিজের মায়ের সাথে ব্যভিচার করেছে।”(সুনান ইবনু মাজাহ, হাদীস: ২২৭৪)

অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “সাতটি ধ্বংসাত্মক পাপ থেকে বেঁচে থাকো।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! সেগুলো কী?” তিনি বললেন—“আল্লাহর সাথে শরিক করা, জাদু করা, নিষিদ্ধ প্রাণ হত্যা করা, এতিমের সম্পদ খাওয়া, সুদ খাওয়া, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানো এবং পবিত্র নারীর উপর অপবাদ দেওয়া।”(সহীহ বুখারী: ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম: ৮৯)

তিনি আরও সতর্ক করেছেন, “যখন তোমরা চতুরতার মাধ্যমে সুদের লেনদেন করবে, কৃষিকাজে মগ্ন থাকবে, জিহাদ ত্যাগ করবে—তখন আল্লাহ তোমাদের উপর অপমান চাপিয়ে দেবেন; এবং তা তিনি দূর করবেন না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের ধর্মের দিকে ফিরে আসো।” (আবূ দাউদ: ৩৪৬২)

রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর এই হাদীসগুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, সুদ এমন একটি গুনাহ যা সমাজে ধ্বংস ডেকে আনে এবং আখিরাতে কঠোর শাস্তির কারণ হয়। ইতিহাস ও বাস্তব জীবনেও এর ভয়াবহ পরিণতি বহুবার দেখা গেছে। 

পাকিস্তানের বিখ্যাত আলেম ও জামিয়া আনওয়ারুল উলূম, করাচির মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাম্মদ নোমান তাঁর গ্রন্থ “সুদ কি মাজাম্মাত ঔর সুদ খানে ওয়ালোঁ কা ইব্রাতনাক আঞ্জাম”-এ এমন কিছু বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করেছেন, যা শিহরিত করে দেয়।

একটি ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়েছে- কোয়েটার এক ব্যক্তি সারা জীবন সুদের ব্যবসা করত। মৃত্যুর পর যখন তাকে কবর দেওয়া হচ্ছিল, হঠাৎ কবরের ভেতর থেকে এক বিশাল কালো সাপ বেরিয়ে এসে মৃতদেহটিকে জড়িয়ে ধরে এবং তার চোখ উপড়ে ফেলে দেয়! উপস্থিত সবাই আতঙ্কে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে জানা যায়, সে জীবিত অবস্থায় মানুষের কাছ থেকে সুদের টাকা আদায় করত এবং কখনো তওবা করেনি।

আরেকটি ঘটনায় দেখা যায়- এক ব্যক্তি সারা জীবন সুদের টাকায় ব্যবসা করেছিল। মৃত্যুর পর তার তিন ছেলে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। তারা কাউকে চিনত না, নিজের যত্ন নিত না, আর্তনাদ করত। স্থানীয় লোকেরা বলত, এটি সুদের গুনাহের পরিণতি।

সুদ শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক ক্ষতিরও কারণ। এটি ধনীদের আরও ধনী ও গরিবদের আরও গরিব করে তোলে, মানবিক সহানুভূতি বিনষ্ট করে, সমাজে হিংসা, বিদ্বেষ ও অশান্তি সৃষ্টি করে। এমনকি আল্লাহর রহমত ও বরকত উঠে যায় এবং সমাজে গজব নাজিল হয়।

তবে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য তওবার দরজা খোলা রেখেছেন। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার প্রভুর উপদেশ পেয়ে সুদ থেকে বিরত থাকে, তার পূর্বেকার যা কিছু হয়েছে তা ক্ষমা করা হবে।” (সূরা আল-বাকারা: ২৭৫)

সুতরাং আমাদের উচিত, এই মহাপাপ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা, সুদমুক্ত ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলা এবং সমাজে ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা।

লেখক : মুহাদ্দিস ও সিনিয়র শিক্ষক সাতগাঁও মাদ্রাসা বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আল কোরআন আল হাদিস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর