Logo

ধর্ম

যেভাবে মহান আল্লাহ মুমিনের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন

Icon

মুফতি খায়রুল হাসান বিন মুজাহিদ

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৪৯

যেভাবে মহান আল্লাহ মুমিনের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন

মানুষের জীবনে সুখ-শান্তির পাশাপাশি দুঃখ-কষ্ট, রোগ-ব্যাধি ও নানা ধরনের বিপদাপদ আসা খুবই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাআলা বান্দার ঈমান যাচাই করার জন্য কখনো কখনো এসব বিপদের মাধ্যমে তাঁকে পরীক্ষা করেন। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদ, প্রাণ ও ফলমূলের ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সূরা বাকারা, ১৫৫)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট- ক্লেশের মধ্যে।’ (সূরা বালাদ, আয়াত ৪) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মানুষ গর্ভাশয়ে আবদ্ধ থাকে। জন্মলগ্নে শ্রম ও কষ্ট স্বীকার করে, এরপর আসে জননীর দুগ্ধ পান করার ও তা ছাড়ানোর শ্রম। অতঃপর জীবিকা ও জীবনোপকরণ সংগ্রহের কষ্ট, বার্ধক্যের কষ্ট, মৃত্যু, কবর ও হাশর এবং তাতে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি, প্রতিদান ও শাস্তি—এসমস্ত শ্রমের বিভিন্ন পর্যায় যা মানুষের উপর দিয়ে অতিবাহিত হয়। এ কষ্ট শুধু মানুষেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য নয়, অন্যান্য জীব-জানোয়ারও এতে শরীক রয়েছে। 

কিন্তু এখানে মানুষের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হলো, প্রথমত মানুষ সব জীব-জানোয়ার অপেক্ষা অধিক চেতনা ও উপলব্ধির অধিকারী। পরিশ্রমের কষ্ট চেতনাভেদে কম-বেশি হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত সর্বশেষ ও সর্ববৃহৎ শ্রম হচ্ছে হাশরের মাঠে পুনরুজ্জীবিত হয়ে সারা জীবনের কাজকর্মের হিসাব দেওয়া। এটা অন্য জীব-জানোয়ারদের ক্ষেত্রে নেই। কোন কোন আলেম বলেন মানুষের মতো অন্য কোন সৃষ্টিজীব কষ্ট সহ্য করে না; অথচ মানুষের শরীর ও দেহাবয়ব অনেক জীবের তুলনায় দুর্বল। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত শক্তিশালী। এ কারণেই বিশেষভাবে মানুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

মক্কা-মুকাররমা ও বনী আদমের শপথ করে আল্লাহ্ তা'আলা এ সত্যটি বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমি মানুষকে কষ্ট ও শ্রমনির্ভরশীলরূপেই সৃষ্টি করেছি।’ এটা এ বিষয়ের প্রমাণ যে, মানুষ নিজে নিজে সুজিত (পরিপূর্ণ) নয় এবং অন্য কোনো মানুষ তাকে জন্ম দেয়নি; বরং তার সৃষ্টিকর্তা এক সর্বশক্তিমান, যিনি প্রত্যেক সৃষ্টিজীবকে বিশেষ স্বভাব ও বিশেষ ক্রিয়াকর্মের যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানব সৃষ্টিতে যদি মানুষের কোন প্রভাব থাকত, তবে সে নিজের জন্য কখনো এরূপ শ্রম ও কষ্ট পছন্দ করত না। (কুরতুবী) 

এ শপথ ও তার জবাবে মানুষকে বলা হয়েছে, ‘তোমরা দুনিয়াতে অনাবিল সুখই কামনা কর এবং কোন কষ্টের সম্মুখিন হতে চাও না; তোমাদের এই কামনা একটি দুঃস্বপ্ন, যা কোনদিন বাস্তব রূপ লাভ করবে না।’ তাই দুনিয়াতে প্রত্যেকের দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হওয়া অপরিহার্য। অতএব, যখন শ্রম ও কষ্ট করতেই হবে, তখন বুদ্ধিমানের কাজ হল এমন বিষয়ে কষ্ট করা, যা চিরকাল কাজে লাগবে এবং চিরস্থায়ী সুখের নিশ্চয়তা দেবে। বলা বাহুল্য, এটা কেবল ঈমান ও আল্লাহ্ আনুগত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমানের ওপর যে কোনো দুঃখ, রোগ, চিন্তা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট, দুঃখ কিংবা দুশ্চিন্তার কাঁটা পর্যন্তই হোক—আল্লাহ তা দ্বারা তার গুনাহসমূহ মোচন করে দেন।’ (সহীহ বুখারী, ৫৬৪১; সহীহ মুসলিম) 

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের উপমা শস্যজাতীয় গাছের ন্যায়। বাতাস সর্বদা তাকে আন্দোলিত করে। অনুরূপভাবে মু’মিনের উপরও সর্বদা বিপদ-আপদ আসতে থাকে। আর মুনাফিকের উপমা দেবদারু বৃক্ষের ন্যায়। মূল না কাটা পর্যন্ত তা প্রকম্পিত হয় না।’ (মুসলিম, হাদিস নং ২৮০৯)

একটি হাদিসে এসেছে,  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে পড়ে যেসব মানুষ, তারা হলেন নবী ও ধার্মিক ব্যক্তিরা। সত্যি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এত দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তেন যে তার কাছে কেবল একটি চাদরই থাকত, যা দিয়ে সে ঘর-বাহির যাতায়াত করত এবং পরিধান করত। কেউ কেউ কেঁচো ও দায়দের দ্বারা কষ্ট ভোগ করতেন, যতক্ষণ না তা তাকে মারত। এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরীক্ষার মধ্যে এত আনন্দিত থাকতেন, যেমন তোমাদের কেউ কেউ দান বা উপহারের মধ্যে আনন্দিত হয়।’ (ইবনে মাজাহ ৪০২৪)

রোগ বা সফরের কারণে যদি কেউ ইবাদত (যেমন রোজা) সম্পূর্ণ করতে না পারে, তখন আল্লাহ তাকে সেই ইবাদতের সমপরিমাণ সওয়াব প্রদান করবেন। (বুখারী, হাদিস নং ২৯৯৬)

মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আল্লাহ তার বান্দার ঈমান ও ধৈর্য পরীক্ষা করেন। একজন সত্যিকারের মুমিন এই কষ্টকে ধৈর্য, ধ্যান ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। প্রতিটি বিপদ, কষ্ট ও পরীক্ষা তাকে গুনাহমুক্তি, আত্মিক উন্নতি এবং চিরস্থায়ী মর্যাদা দান করে। তাই দুনিয়ার স্বল্প সুখের জন্য কষ্ট ভয় পাওয়ার পরিবর্তে, চিরস্থায়ী সুখ ও আল্লাহর প্রিয়তা অর্জনের জন্য এই কষ্টকে সম্ভাবনার মাধ্যমে গ্রহণ করা উচিত।

লেখক : মুহাদ্দিস ও সিনিয়র শিক্ষক সাতগাঁও মাদ্রাসা বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়ি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর