ইলেকট্রিক ব্যাট দিয়ে মশা মারা কি ইসলামে বৈধ?

মুফতি খায়রুল হাসান বিন মুজাহিদ
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৬

বাংলাদেশে গরম হোক বা শীত- সবসময় রাতে মশার কামড়ে ঘুম হারাম হয়ে যায়, আর এই অভিজ্ঞতা প্রায় সবারই হয়েছে। তাই মানুষ নানা উপায়ে মশা থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এখন বাজারে সহজে পাওয়া যায় ‘ইলেকট্রিক ব্যাট’ বা মশা ধ্বংসকারী যন্ত্র। এতে মশা কারেন্টের শক খেয়ে দ্রুত মারা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—ইসলামের দৃষ্টিতে এই যন্ত্র ব্যবহার করা বৈধ কি না?
এর ব্যাখ্যায় বলা যায়- যেহেতু ইসলাম মানবকল্যাণের ধর্ম। মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষা করা ইসলামের অন্যতম উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে প্রাণীর প্রতি দয়া, অযথা কষ্ট না দেওয়া এবং নিষ্ঠুরতা থেকে বিরত থাকা, এসবও ইসলামের শিক্ষা। তাই ক্ষতিকর জীব বা পতঙ্গ যেমন- মশা, মাছি ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়া জরুরি হলেও, কীভাবে প্রতিরোধ করা হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ এমন কোনো পদ্ধতি যেন ব্যবহার না হয় যাতে প্রাণীকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে কষ্ট দেওয়া হয়।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবের প্রতি করুণা করতে বলেছেন। তিনি আগুন দিয়ে প্রাণী পোড়ানো নিষিদ্ধ করেছেন। হাদীসে বর্ণিত আছে, ‘হযরত আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন- এক সফরে আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলাম। আমরা এক চড়ুই পাখির বাচ্চা ধরে ফেলি, তখন মা পাখিটি ডানা ঝাপটাতে থাকে। নবী করীম (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই পাখিটিকে কে কষ্ট দিচ্ছে? বাচ্চাগুলো ফিরিয়ে দাও।’ এরপর তিনি একটি পিঁপড়ার গর্ত দেখলেন, যেটা আমরা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। নবী করীম (সা.) বললেন, ‘আগুন দিয়ে শাস্তি দেওয়া শুধু আগুনের রব—আল্লাহরই কাজ।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদীস ২৬৭৫) এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, আগুন বা তীব্র যন্ত্রণার মাধ্যমে প্রাণী হত্যা করা ইসলামে অপছন্দনীয় (মাকরুহ)।
ফুকাহায়ে কেরাম বা ইসলামী ফকীহগণ বলেন, ইসলাম আগুনে পোড়ানো বা বিদ্যুৎ দিয়ে প্রাণী হত্যা করা সাধারণভাবে নিরুৎসাহিত করে থাকে। তবে যদি এমন পরিস্থিতি হয় যে অন্য কোনো উপায় নেই এবং মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে সেটাই একমাত্র কার্যকর উপায়—তাহলে তা সীমিতভাবে অনুমোদনযোগ্য হতে পারে।
যেমন ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াতে আছে—‘আগুনে প্রাণী পোড়ানো বা হত্যা করা মাকরুহ।’ (৫/৩৬১)
মৌমাছি বা ভোঁড়া” বা “ভিমরুলি আগুনে পোড়ানো ঠিক কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে এ ব্যাপারে ফতোয়ায়ে রশিদিয়াতে বলা হয়েছে যে, যদি অন্য কোনো উপায় না থাকে, তখন আগুন জ্বালিয়ে পোড়ানো যাবে। (মাকতাবা যাকারিয়া, পৃষ্ঠা ৫৯৭)
এমদাদুল ফতোয়াতে বলা হয়েছে : ‘যদি কোনো প্রাণী (যেমন সিয়াহ) ফসল নষ্ট করে এবং আগুন ছাড়া উপায় না থাকে, তাহলে আগুন দেওয়া যায়। কিন্তু অন্য উপায় থাকলে আগুন দেওয়া ঠিক নয়।’ (৪/২৬৫)
ফতোয়া মাহমুদিয়াতে বলা হয়েছে, ‘যদি আগুন ছাড়া রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে আগুন জ্বালানো বড় পাপ। কেবল বিকল্প না থাকলে তা করা যেতে পারে।’ (মাকতাবা যাকারিয়া ১২/৩৭৬)
উপরোল্লিখিত ফতোয়া ও হাদীসের আলোকে বোঝা যায়, কোনো প্রাণীকে কষ্ট দিয়ে হত্যা করা শরীয়তে নিষিদ্ধ। কাজেই ইলেকট্রিক ব্যাট” দ্বারা মশা মারার অনুমতি নেই। তবে যদি বিকল্প উপায় না থাকে এবং মশা বা ক্ষতিকর পতঙ্গ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র কার্যকর উপায় হয় ইলেকট্রিক ব্যাট, তাহলে তা ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, এ ব্যাপারে আরেকটি বৈজ্ঞানিক মত হচ্ছে, যেহেতু ইলেক্ট্রিক ব্যাট দিয়ে মশা-মাছি মারা কিছু আলেমের মতে বৈধ। আর তাদের যুক্তি হলো- ইলেক্ট্রিক ব্যাট দিয়ে সরাসরি মশাকে পুড়িয়ে মারা হয় না। বরং প্রথমে কারেন্টের শক দিয়ে মারা হয়; তারপর আরেকবার সুইচে চাপ দিলে মশা আগুনে পুড়ে। আর কোনো প্রাণির মৃত্যুর পর তাকে আগুনে পোড়ানো বৈধ। সে হিসেবে ইলেক্ট্রিক ব্যাট দিয়ে মশা মারাও জায়েজ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে প্রাণী ও সৃষ্টিজীবের প্রতি সদয় হওয়ার তাওফিক দান করুন, আমীন।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক সাতগাঁও মাদ্রাসা বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া