
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তের সূচনা হয় ইলম অর্জনের মাধ্যমে। ইসলামের ইতিহাসে একটি মহান ঘটনা, যা তাঁর জীবন এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য বিবেচিত হয় একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে। ৪০ বছর বয়সে মক্কার হেরা গুহায় নবীজি (সা.) প্রথম ওহি লাভ করেন। এর আগে স্বপ্নযুগে ওহিপ্রাপ্ত হওয়ার বর্ণনাও পাওয়া যায়। তবে হেরা গুরায় সরাসরি ওহি নাজিল হওয়া শুরু হয়।
“একদিন তিনি গুহায় থাকাকালীন ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) তাঁর কাছে এসে বললেন, ‘ইকরা’ (পড়ো)। তিনি বললেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না।’ ফেরেশতা তাঁকে জড়িয়ে ধরে এত জোরে চাপ দিলেন যে তিনি প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব করলেন। এরপর তিনি তাঁকে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, ‘ইকরা’। তিনি পুনরায় বললেন, ‘আমি পড়তে জানি না।’
ফেরেশতা দ্বিতীয়বার তাঁকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন এবং ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, ‘ইকরা’।
তৃতীয়বার তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিয়ে বললেন, (সুরা আলাকের ১-৫ আয়াত) ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ো, তোমার প্রভু সবচেয়ে দয়ালু, যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না’।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩)
প্রথম ওহির ঘটনা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে একটি ঐতিহাসিক মোড়। এটি কেবল তাঁর নবুয়তের সূচনাই নয়, বরং মানবজাতির জন্য ঐশী পথনির্দেশের শুরু। সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত জ্ঞান, শিক্ষা এবং সৃষ্টির মহানতার ওপর জোর দিয়েছে। “ইকরা” (পড়ো) শব্দটি ইসলামের জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। কেননা সুশিক্ষার মাধ্যমে একটি জাতিকে সহজেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসা যায়।
রাসুল (সা.) বলেন, ইসলামের জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ। (সহিহ মুসলিম) মানুষের জীবন পরিচালিত করতে যতটুকু ইলমের প্রয়োজন ততটুকুই ফরজ। ফরজ পরিমাণ ইলম সকলকেই শিখতে হবে। অন্যথায় ফরজ তরকের গোনাহ হবে। যেমন গোনাহ হয় নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি ছেড়ে দিলে। সাহাবাগণ প্রিয় নবী (সা.)-এর সাহচর্যে গিয়ে ইলম-আমল শিখেছেন। পরবর্তীগণও পূর্ববর্তীদের কাছে গিয়ে দ্বীন শিখেছেন।
এ ধারা চলমান ছিল দীর্ঘ শতাব্দী পর্যন্ত। সে সময় এখনকার মতো মাদরাসার অবকাঠামো ছিল না। পরবর্তীতে সময় ও সমাজের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট অবকাঠামো অনুযায়ী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যেখানে নির্দিষ্ট বয়সের মুসলিম সন্তান-সন্ততি ইলম শিখে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, মাত্র এক ভাগ ছাত্র মাদরাসাতে লেখাপড়া করে। অর্থাৎ ইলমে দ্বীন শিক্ষা লাভ করে। বাকি ৯৯ ভাগ দ্বীন সম্পর্কে উদাসীন। ব্যতিক্রম কিছু মানুষ হয়তো ব্যক্তি উদ্যোগে দ্বীনি ইলম জানতে সচেষ্ট হয়। অবশিষ্ট লক্ষ লক্ষ চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী,কুলি, দিনমজুর, রিকশা চালক, গার্মেন্টকর্মী ইত্যাদি দ্বীন-ইলসাম ও ইলম সম্পর্কে অবুজ,অজ্ঞ। এসব মানুষের ওপরও ইলম শিক্ষা করা ফরজ। কিন্তু এ বিশাল কর্মমুখী জনগোষ্ঠী কীভাবে ইলম শিখবে? কে তাদের ইলম শেখানোর দায়িত্ব নেবে?
রাসুল (সা.) উম্মতের প্রতি ছিলেন দরদি। আমৃত্য উম্মতের হেদায়েতের জন্য অশ্রæ ঝরিয়েছেন। তবে দুঃখ! আজ সে উম্মত প্রায় হেদায়েত বিচ্যুত হচ্ছেন। ইলম-আমলশূন্য জীবনযাপন করছেন। ইসলামি মাহফিল, তাবলিগ বা খানকাতে গিয়ে মানুষ দ্বীনের পথে ঝোকে; কিন্তু ইলম শিখতে পারে না। সুতরাং সর্বশ্রেণির মানুষের ইলম শেখার একটি সুন্দর পথ হতে পারে নৈশ মাদরাসা বা বয়স্ক মাদরাসা। যেখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের সময় ও সুযোগ মতো ইলম শিখতে পারবে। কর্ম ব্যস্ততা থেকে ফারেগ হয়ে ১/২ ঘণ্টা সময় বের করে ইলম শিখবে। আমাদের কাছে বিষয়টি কঠিন মনে হলেও বাস্তবে এর ফলাফল সম্ভব।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১০০টির মতো নৈশ মাদরাসা আছে। যেখানে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি- পেশার মানুষ ইলম শিখছে। আশ্চর্যের কথা হলো, নৈশ মাদরাসাতে পড়ে হাজার হাজার মানুষ পূর্ণ দ্বীন ফিরে পেয়েছেন। এটা সত্যি অবাক হওয়ার মতো বিষয়।
ঢাকার মুহাম্মদপুরে প্রতিষ্ঠা হয়েছে আন-নূর ইসলামিয়া নৈশ মাদরাসা। ২০০৩ সালে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর উদ্ভাবক ও প্রতিষ্ঠাতা মুফতি জুবায়ের মাজাহেরী হাফিজাহুল্লাহ। ৭ বছরে দাওরা পর্যন্ত নেছাব তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে মাদরাসাটিতে তিন শতাধিক মানুষ ইলম শিখছে।
কর্মমুখী বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষ এ মাদরাসাতে পড়ে আলেম হয়েছেন এর সংখ্যা অনেক। মাদরাসার মুহতামিম মুফতি জুবাইর মাজাহেরী সাহেবের দেওয়া তথ্য মতে যারা এখানে পড়ে আলেম হয়েছেন তাদের ছোট একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হলো।
১. মাওলানা মুহাম্মদ আলী (জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফি বিভাগের প্রধান)
২. ডা. মাওলানা তানভির (চক্ষু বিশেষজ্ঞ)
৩. ডা. মাওলানা মুহসিন (পিজি হাসপাতাল সার্জারি বিভাগ) তিনি জামিয়া লালবাগ থেকে ইফতাও পড়েছেন।
৪. মাওলানা আব্দুল মতিন ( লেকচারার এশিয়া ইউনিভার্সিটি)
৫. মাওলানা সালেহ আহমদ (বিশিষ্ট ব্যবসায়ী)
৬. ইঞ্জিয়ার শাহাদাত (নিজস্ব আইটি ফার্ম পরিচালক)
৭. মাওলানা মাদলাজ (ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
৮. মাওলানা তানজিম (সিএনজি চালক)
৯. মাওলানা শাব্বির আহমদ (পূর্বে নাট্যকার ছিলেন)
এছাড়াও রাজমিস্ত্রি, রিকশাচালকসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আলেম হয়েছেন। সকলেই কওমি শিক্ষাবোর্ড বেফাক এবং আল-হাইয়াআতুল উলয়া থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন। আন- নূর নৈশ মাদরাসার মুহতামিম প্রমাণ করেছেন চেষ্টা করলে কর্মব্যস্ত মানুষও আলেম হতে পারেন। বিষয়টি গভীরভাবে ভাবার অবকাশ রাখে।
আমরা শুধু মুসলিম বাচ্চাদের দ্বীন শেখানোর কাজে ব্যস্ত। কিন্তু কোটি কোটি কর্মব্যস্ত মানুষের ইলম শেখানোর কথা আমরা ভাবি না। অথচ সাহাবাগণ দিনে কাজ করে রাতে ইলম শিখতেন। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, কতিপয় লোক নবী (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, আমার সঙ্গে এমন কিছু লোক দিন যারা আমাদের কোরআন, সুন্নাহ শিক্ষা দেবে। তখন রাসুল (সা.) আনসারদের সত্তর ব্যক্তিকে তাদের সঙ্গে প্রেরণ করলেন। যাদের কুররা (ক্বারী সমাজ) বলা হতো। তারা কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং রাতে ইলম শিখতেন। আর দিনে পানি সংগ্রহ করে মসজিদে রাখতেন,কাঠ সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে সে টাকা সুফফাবাসী এবং নিঃস্ব ফকিরদের জন্য খাদ্য ক্রয় করতেন। কিন্তু শয়তানগুলো এই সত্তরজন সাহাবিকে গন্তব্যে পৌঁছার আগেই হত্যা করে। (সহিহ মুসলিম)
হাদিস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় দিনে কাজ করে রাতে ইলম শেখা সম্ভব। সাহাবাগণ এভাবেই ইলম শিখতেন। সুতরাং মসজিদের ইমাম, খতিব, মাদরাসার শিক্ষকগণ যদি নৈশ মাদরাসা নিয়ে নতুন করে ভাবেন তবে অনেক মানুষ ফরজ পরিমাণ ইলম শিখতে পারবে। উলামাদের সঙ্গে সাধারণদের একটি মেলবন্ধন তৈরি হবে।
তবে নৈশ মাদরাসার রূপরেখা কেমন হবে, কীভাবে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করবেন সে বিষয়ে মুফতি জুবায়ের মাজাহেরী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। কারণ বাংলাদেশে তিনিই প্রথম বিষয়টি নিয়ে দরদি ভাবনা ভেবেছেন এবং দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। উম্মতের দরদি উলামাগণ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাববেন বলে আশা করি।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
বিকেপি/এমবি