জ্ঞানচর্চা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় কওমি মাদরাসা

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৩

ইসলামি শিক্ষা ও নৈতিকতার ধারক-বাহক হিসেবে কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের উপমহাদেশে এক গৌরবময় ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এটি কেবল ধর্মীয় পাঠদানের কেন্দ্র নয়; বরং মানুষ গড়ার এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এখানে জ্ঞান, আদর্শ ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধনে গড়ে ওঠে এমন এক প্রজন্ম, যারা সমাজে সত্য, ন্যায় ও মানবতার দিশা দেখায়।
কওমি মাদরাসার ওলামায়ে কেরাম যুগে যুগে ইসলামি জ্ঞান সংরক্ষণ, নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং জাতির আত্মপরিচয় জাগিয়ে তোলার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
কওমি মাদ্রাসার ইতিহাস ইসলামি সভ্যতার গভীর শিকড়ে প্রোথিত। উপমহাদেশে মুসলিম শাসনামলে ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে এর সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেখা যায় ১৮৬৬ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ধর্মবিরোধী নীতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেওবন্দ ছিল এক দৃঢ় প্রতিরোধ আন্দোলন। এখান থেকেই শুরু হয় কওমি শিক্ষা আন্দোলনের যাত্রা। যার লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা, আত্মত্যাগ, নেতৃত্বগুণ ও মুসলিম আত্মপরিচয়ের জাগরণ।
ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা বিকাশে ভূমিকা
কওমি মাদরাসার মূল উদ্দেশ্য ইসলামের মৌলিক জ্ঞান অর্জন ও প্রচার। এখানে কোরআন, হাদিস, ফিকহ, তাফসির, আরবি সাহিত্য, যুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানী, নৈতিক ও আল্লাহভীরু মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। ওলামায়ে কেরাম সমাজে নৈতিকতার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা অন্যায়, মিথ্যা, লোভ ও অবিচারের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর তোলেন; মানুষকে আল্লাহভীতি, সততা ও মানবপ্রেমের চেতনায় জাগিয়ে তোলেন। যখন সমাজে ভোগবাদ ও নৈতিক অবক্ষয় বাড়ে, তখন তাঁরাই মানুষের মনে ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার আলো জ্বালিয়ে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনেন।
জাতীয় জীবনে অবদান
বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে কওমি আলেমদের অবদান অপরিসীম। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি আন্দোলনে তাঁরা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সংকটের সময়ে তাঁরা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, মানবিক সহায়তা দিয়েছেন এবং শান্তি ও ন্যায়ের আহ্বান জানিয়েছেন।
স্বাধীনতার পরও ওলামায়ে কেরাম দেশের ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অবদান রেখে চলেছেন। তাঁরা গ্রামীণ সমাজে শিক্ষা বিস্তার, দাওয়াতি কার্যক্রম ও মানবসেবার মাধ্যমে সমাজে নৈতিক ভিত্তি মজবুত করছেন।
সরকার কর্তৃক “দাওরায়ে হাদিস”-কে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া তাঁদের দীর্ঘ দিনের ত্যাগ ও অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
সামাজিক ও মানবিক সেবায় অবদান
কওমি মাদ্রাসাগুলো শুধু ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র নয়; সমাজসেবার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। এসব প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য অনাথ ও দরিদ্র শিক্ষার্থী বিনামূল্যে শিক্ষা, খাদ্য ও আবাসনের সুযোগ পায়। দান, জাকাত ও সদকার অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণের দরজা খুলে দিয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি কিংবা সংকটের সময়ে ওলামায়ে কেরাম প্রথম সারিতে থেকে জনগণের সেবা করেছেন। তাঁরা ত্রাণ বিতরণ, আশ্রয় প্রদান ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবতার প্রকৃত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইসলাম যে মানবকল্যাণের ধর্ম, তার বাস্তব প্রতিফলন কওমি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়েছে।
জ্ঞানচর্চা ও সাহিত্য বিকাশে ভূমিকা
ওলামায়ে কেরাম কেবল শিক্ষক বা বক্তা নন; তাঁরা গবেষক, চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকও। তাঁদের রচিত বই, প্রবন্ধ ও ফতোয়া ইসলামি জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁরা ইসলামের মৌলনীতি ও দর্শন সাধারণ মানুষের কাছে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন, ফলে ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণা দূর হয়েছে।
বাংলা ভাষায় ইসলামি গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সাহিত্যচর্চায় কওমি আলেমদের অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁদের রচনাশৈলী ও চিন্তাভাবনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইসলামি সাহিত্যপ্রীতি জাগিয়ে তুলছে।
বর্তমানে অনেক কওমি আলেম সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে জাতীয় পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও গবেষণামূলক সাময়িকীতে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। তাঁদের প্রাঞ্জল কলম, বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক দিকনির্দেশনার কারণে অনেকেই আজ জাতীয় পত্রিকাগুলোর সম্পাদনা বা পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এটি প্রমাণ করে যে কওমি শিক্ষা কেবল ধর্মীয় জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি চিন্তা, গবেষণা ও সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রেও এক উজ্জ্বল ধারার জন্ম দিয়েছে।
সমকালীন সমাজে প্রাসঙ্গিকতা ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ
বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর, প্রতিযোগিতামূলক ও বস্তুবাদে পরিপূর্ণ। এই যুগে নৈতিকতার অভাব, পারিবারিক সংকট ও মানসিক অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে। এমন সময়েও কওমি মাদরাসা শিক্ষা তার গুরুত্ব হারায়নি; বরং আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই শিক্ষা মানুষকে নৈতিকতা, আত্মশুদ্ধি, সহনশীলতা ও মানবিকতার দীক্ষা দিচ্ছে- যা আজকের সমাজে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।
তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কওমি শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও ভাষাশিক্ষা সংযোজন জরুরি। এতে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি আধুনিক সমাজেও নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। কওমি শিক্ষা যেমন ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষা করছে, তেমনি আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়ে সমাজ গঠনে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, কওমি মাদ্রাসা ও ওলামায়ে কেরাম বাংলাদেশের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁদের ত্যাগ, নেতৃত্ব, শিক্ষাচর্চা ও সাহিত্যিক অবদান জাতির নৈতিক ও আত্মিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছে।
তাঁরা শুধু ইসলাম প্রচারক নন- তাঁরা সমাজের নৈতিক দিশারি, সাহিত্যিক চিন্তার জাগরণী এবং মানবতার সেবক। এখন সময় এসেছে এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাকে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা- গবেষণা, সরকারি সহায়তা ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে। কারণ, কওমি শিক্ষা শুধু ধর্মীয় পাঠ নয়; এটি এক পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শনের দিশা, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত, নৈতিক ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে।
লেখক : ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধকার
drmazed96@gmail.com
বিকেপি/এমবি