দ্বীনি শিক্ষা সন্তানকে শ্রেষ্ঠ মানুষ বানায়

মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ
প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:৪৯
-68f75729160b0.png)
ইসলামি শরিয়তে সন্তানের সঠিক পরিচর্যা, নৈতিক উন্নয়ন, পারলৌকিক ও পার্থিব কল্যাণ, উত্তম গুণাবলি, তাকওয়া-তাহারাত, আত্মশুদ্ধি ও আদর্শ নৈতিকতা গড়ে তোলার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর; যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য।” (সুরা তাহরীম: ৬)
হজরত আলী (রাযি.) এই আয়াতের তাফসিরে বলেন, “তোমরা সন্তানদের উত্তম শিষ্টাচার শিখাও।” উম্মাহর ফকীহগণ এই ব্যাপারে একমত যে, ‘‘প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর ফরজ হলো সে যেন তার স্ত্রী-সন্তানকে দ্বীনি ফরজ শিক্ষা, হালাল-হারামের বিধান এবং ঈমানী দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা দেয় এবং আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।’’
হাদিসে সন্তান গঠনের গুরুত্ব: সন্তান গঠনের গুরুত্ব কতটুকু, তা আমরা রাসুল (সা.) এর হাদিস থেকেও জানতে পারি। হজরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, সাহাবায়ে কেরাম একবার জিজ্ঞেস করলেন: “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা তো পিতামাতার হক জানলাম; এখন বলুন, সন্তানের কী কী হক রয়েছে আমাদের ওপর?” তিনি বললেন: “তাদের সুন্দর নাম রাখো এবং তাদের উত্তম শিক্ষা ও আদব শেখাও।” (সুনানে বায়হাকী)। আরেক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন: “কোনো বাবা তার সন্তানকে আদবের চেয়ে উত্তম কিছু দান করতে পারে না।” (বুখারি)
অর্থাৎ, সন্তানকে সুশিক্ষা ও শিষ্টাচার শেখানোই পিতার পক্ষ থেকে সন্তানের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।
সন্তানের প্রথম শিক্ষক তার মা: সন্তানকে গঠন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রাখেন তার মা। সন্তানের জীবনে সবচেয়ে প্রভাবশালী জায়গা হচ্ছে মায়ের কোল। একজন মা যদি দ্বীনদার, পরহেজগার, বিশ্বস্ত, দায়িত্ববান, মেহমানপরায়ণ, দরিদ্র-অসহায়ের সহায় এবং আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হন, তাহলে সেই মায়ের ছায়ায় বেড়ে ওঠা সন্তান খুব দ্রæতই হয়ে ওঠে সৎরিত্রবান, ন্যয়পরায়ণ, জ্ঞানপিপাসু এবং সমাজের আলোকবর্তিকা। ইতিহাসে দেখা যায়, মহান ব্যক্তিদের গঠনের পেছনে তাঁদের মায়েদের ভ‚মিকা ছিল বিস্ময়কর।
তরবিয়তের মর্ম ও তার প্রকারভেদ: ‘‘তরবিয়ত’’ শব্দটি অনেক বিস্তৃত। এটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং পরিবার, সমাজ ও জাতির প্রশিক্ষণ ও গঠনের বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করে। এর চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য হলো একটি পরিশুদ্ধ, সুসংহত ও চারিত্রবান, ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
তরবিয়তের সংজ্ঞা এভাবেও হতে পারে যে “খারাপ আচরণ ও অসুস্থ সমাজকে উত্তম চরিত্র ও সুন্দর সমাজে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া।”
তরবিয়তের দুইটি ধারা: এক) বাহ্যিক তরবিয়ত: সন্তানের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, বন্ধুবান্ধব, চলাফেরা, পড়াশোনার অবস্থা এবং জীবনধারা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নজরদারি।
২. অভ্যন্তরীণ তরবিয়ত: ঈমান, আকিদা, নামাজ-রোজা, সত্যবাদিতা, ভদ্রতা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি গড়ে তোলার বিষয়। এই দুই দিকের তরবিয়তের দায়িত্ব একান্তভাবেই পিতামাতার ওপর ন্যস্ত। এই দায়িত্ব পালন করা তাদের জন্য অপরিহার্য।
সংশোধন করুন সহানুভ‚তির সঙ্গে: পিতা-মাতার অন্তরে সন্তানদের জন্য থাকে অপরিসীম মমতা। সেই মমতাই তাদের দায়িত্ব পালনে উৎসাহ দেয়। সন্তান কোনো ভুল করলে সঙ্গে সঙ্গেই শাসন নয়- বরং বিষয়টি বুঝে, কারণ অনুসন্ধান করে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। কখন উপদেশ কাজে দেবে, আর কখন কঠোরতা প্রয়োজন- এটুকু বুঝে ব্যবস্থা নেওয়াই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক হবে।
রাসুল (সা.) এর স্নেহমাখা শিক্ষা: হজরত উমর ইবনে আবি সালাম (রাযি.) বলেন: “আমি ছোটবেলায় রাসুল (সা.) এর তত্ত¡াবধানে ছিলাম। খাওয়ার সময় আমার হাত এদিক-সেদিক যেত। তখন রাসুল (সা.) বললেন: ‘‘হে বৎস! “বিসমিল্লাহ” বলে খাও, ডান হাতে খাও এবং তোমার সামনে থেকে খাও।’’ (সহিহ বুখারী) এভাবে স্নেহ ও মমতা মিশিয়ে সন্তানকে শিক্ষা-দীক্ষা দেয়ওাই একজন আদর্শ অভিভাবকের পরিচয়। আর নববী আদর্শ শিক্ষাকেন্দ্রই হলো কওমি মাদরাসা।
পরিশেষে, হজরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন: “যদি আলেম না থাকতেন, মানুষ পশুর মতো হয়ে যেত।” অতএব, সকল পিতা-মাতার উচিত সন্তানদের সঠিক ও পূর্ণ দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করা, তাদের চরিত্র গঠন ও আদবের প্রতি সচেতন থাকা। যেন তারা বড় হয়ে সমাজ, দেশ এবং উম্মাহর জন্য উপকারী মানুষ হতে পারে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই মহান দায়িত্ব পালনের তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা।