কওমির দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা : প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনা

মাহফুজ হোসাইনী
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩২

ছাত্রজীবন- জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়টা যেমন স্বাচ্ছন্দ্যময়, তেমনি দায়িত্বপূর্ণও। তবে এই জীবনের একটি দিক প্রায় সবার কাছেই কিছুটা ভীতিকর। তা হলো পরীক্ষা। পুরোনো কথা হলেও সত্য, ‘ছাত্রজীবন সুখের জীবন, যদি না থাকে পরীক্ষা।’
বর্তমানে দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে চলছে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার মৌসুম। কিছু মাদরাসায় ইতোমধ্যে পরীক্ষা শুরু হয়েছে, আর অধিকাংশে সামনের সপ্তাহে শুরু হবে। সাধারণত পরীক্ষা আসলেই অনেক শিক্ষার্থী দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়- কীভাবে পড়বে, কোথা থেকে শুরু করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
কওমি মাদরাসায় পরীক্ষার আগে সাধারণত এক থেকে দেড় সপ্তাহের ‘খেয়ার’ দেওয়া হয়। অর্থাৎ ক্লাস বন্ধ রেখে পরীক্ষার প্রস্তুতির সুযোগ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেক শিক্ষার্থী এই সময়টি অবহেলায় নষ্ট করে ফেলে। আজকের এই প্রবন্ধে কওমি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি ও করণীয় বিষয়ে থাকছে বিশেষ কিছু দিকনির্দেশনা।
পরীক্ষার মানসিক প্রস্তুতি
‘পরীক্ষা’ শব্দটি শুনলেই মনে এক ধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করে। কারণ পরীক্ষা কখনোই খুব সহজ নয়; কিছুটা কষ্টসাধ্য তো বটেই। কষ্ট ছাড়া মিষ্টি মেলে না। এটাই বাস্তবতা। আসলে মানুষের পুরো জীবনটাই এক পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন- “আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।” (সূরা আল-বাকারা: ১৫৫) তাই পরীক্ষাকে ভয় না পেয়ে, ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। মানসিক দৃঢ়তা থাকলে অর্ধেক পথই পেরোনো হয়ে যায়।
অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের গুরুত্ব
পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য কোনো শর্টকাট পথ নেই। পরিশ্রমই সফলতার অন্যতম প্রধান উপায়। খেয়ারের সময়টুকু যেন এক মুহূর্তও নষ্ট না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যতটুকু সময় পাওয়া যায়, ততটুকুই সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে হবে। অলসতা ও সময় নষ্ট করা সফলতার পথে বড় বাধা।
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘প্রত্যেকের জন্য মর্যাদা রয়েছে তার কর্ম অনুসারে, যেন আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেন; তাদের প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না।’
(সূরা আল-আহকাফ: ১৯) অর্থাৎ পরিশ্রমের প্রতিদান নিশ্চিত। সুতরাং কঠোর অধ্যবসায়ই সফলতার চাবিকাঠি।
কীভাবে পড়বে, কতটুকু পড়বে
পরীক্ষার সময় অনেক শিক্ষার্থী দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে- কী পড়বে, কতটুকু পড়বে, কোথা থেকে শুরু করবে, কীভাবে পড়বে? এসব প্রশ্নে বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এর সঠিক সমাধান অনেকের জানা থাকে না। অথচ এর উত্তরণ খুব সহজ, যদি আমরা কওমি মাদরাসায় পরীক্ষার উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে পারি।
স্কুল বা কলেজে পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য থাকে ভালো নাম্বার অর্জন। কিন্তু কওমি শিক্ষার লক্ষ্য ভিন্ন। এখানে মূল উদ্দেশ্য হলো কিতাব আয়ত্ত করা এবং প্রকৃত ইলম অর্জন করা। নাম্বার পাওয়া বা না পাওয়া কওমি ব্যবস্থায় মুখ্য নয়। একজন শিক্ষার্থী যদি কিতাব ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারে, তবে স্বাভাবিকভাবেই ভালো ফলাফল আসবে। কিন্তু যদি শুধুই নাম্বারের পেছনে দৌড়ায়, অথচ কিতাবের অর্থ-বোঝা ও অধ্যয়ন না করে, তবে সেটি প্রকৃত সাফল্য নয়।
পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পড়ার সঠিক পদ্ধতি হলো- তাকরার (পুনরায় পড়া) ও ধারাবাহিক অধ্যয়নের মাধ্যমে পূর্বে শেখা পড়াগুলো আয়ত্ত করা। শুরু থেকে নিয়ে যতটুকু পড়া হয়েছে, সবই পুনর্বিবেচনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে দৃঢ় করা জরুরি। কোনো অধ্যায় বা অংশ বাদ না রাখা। জেনারেল শিক্ষার ন্যায় সাজেশন ধরে ধরে কিতাবের কিছু অংশ আয়ত্ত করা সাময়িক ফল দিতে পারে, কিন্তু তা জ্ঞানের গভীরতা আনে না।
বর্তমানে কিছু শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজের ধারা অনুসরণ করে নাম্বারের জন্য পড়াশোনা করে। ফলে দেখা যায়, কেউ কেউ দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত ভালো ফল করলেও সহিহ করে এক লাইন ইবারত পড়তে পারে না। কিতাব বুঝে পড়তে পারে না। এটি কওমি শিক্ষার উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেয়।
কওমি শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য
মনে রাখতে হবে, কওমি শিক্ষা কোনো জাগতিক শিক্ষা নয়। এটি আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা- যার লক্ষ্য শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। জাগতিক শিক্ষায় নাম্বারই সাফল্যের মাপকাঠি, কিন্তু দীনী শিক্ষায় মুখ্য হলো ইলমের বরকত ও আমলের সামর্থ্য অর্জন।
কিতাব আয়ত্ত না করে শুধুমাত্র নাম্বারের মাধ্যমে মানুষের বাহবা পাওয়া সম্ভব হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়। তাই ইলমের পথে আন্তরিকতা, অধ্যবসায় ও নিয়তের পবিত্রতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
পরীক্ষার হলে নৈতিক সততা
পরীক্ষার সময় মনে রাখতে হবে- নকল করা, অন্যের কাছ থেকে দেখা, কথা বলা বা প্রতারণা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নকল করে দুনিয়ার পরীক্ষায় পাশ করা সম্ভব হলেও, আল্লাহর পরীক্ষায় তা ব্যর্থতার কারণ হবে। একটু নাম্বারের লোভে চিরস্থায়ী নাজাতকে ঝুঁকির মুখে ফেলা নিছক বোকামি।
পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের কিছু দোয়া
পরীক্ষা আতঙ্কে অনেকে ভুলে যায় পূর্বে পড়া বিষয়। তখন মন স্থির রাখতে ও স্মরণশক্তি বাড়াতে কিছু দোয়া পড়া যেতে পারে। ইনশাআল্লাহ এতে উপকার মিলবে।
১️. উচ্চারণ: ‘রাব্বি যিদনি ইলমা’। অর্থ : ‘হে আমার প্রতিপালক, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।’ (সূরা ত্বাহা: ১১৪)
২️. উচ্চারণ : ‘রব্বিশ রাহলী সদরী ওয়া ইসসিরলী আমরী, ওয়াহলুল উকদাতাম মিল লিসানি ইয়াফকাহু কওলি’। অর্থ : ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করুন, আমার কাজ সহজ করে দিন এবং আমার জিহ্বার জড়তা দূর করুন, যাতে লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সূরা ত্বাহা: ২৫-২৮)
৩️. উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আইয়িদনি বিরূহিল কুদুস’। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে পবিত্র আত্মার মাধ্যমে শক্তি দিন।’ (বুখারি, মুসলিম)
৪️. উচ্চারণ : ‘রব্বি ইয়াসসির ওয়ালা তুআসসির, ওয়াতাম্মিম বিল খাইর"। অর্থ: “হে আমার প্রতিপালক! আপনি সহজ করে দিন, কঠিন করবেন না এবং কল্যাণের সাথে সমাপ্ত করুন।’ (বায়হাকি)
পরীক্ষার শুরুর পূর্বে দোয়া
আল্লাহুম্মা ইন্নি তাওাক্কালতু আলাইকা ওয়া সাল্লামতু আমরি ইলাইকা, লা মালজায়া ওলা মানজায়া মিনকা ইল্লা ইলাইকা।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার উপর ভরসা করেছি, আমার সমস্ত বিষয় আপনার হাতে সঁপে দিয়েছি। আপনার ছাড়া অন্য কোনো আশ্রয় নেই।’
পরীক্ষার হলে কিছু ভুলে গেলে
পরীক্ষার হলে কোনো পড়া বিষয় যদি মনে করতে না পারেন, বা ভুলে যেয়ে থাকেন; তাহলে এই দোয়াটি পড়তে পারেন। উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা জাক্কিরনি মিনহু মা নাসিতু, ওয়া আল্লিমনি মিনহু মা জাহিলতু’। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি যা ভুলে গেছি তা স্মরণ করিয়ে দিন এবং যা জানি না তা আমাকে শিখিয়ে দিন।’
উপসংহার
কওমি মাদরাসায় পরীক্ষা কেবল নাম্বার পাওয়ার বিষয় নয়, বরং এটি ধৈর্য, সততা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন। নিয়মিত অধ্যয়ন, দোয়া, দরুদ ও আল্লাহর উপর ভরসাই পরীক্ষায় সফলতার মূল চাবিকাঠি। শুধু পড়াশোনা নয়, বরং ইলমকে আমলের মাধ্যমে জীবনে রূপান্তরিত করাই প্রকৃত কওমি শিক্ষার্থীর লক্ষ্য।
লেখক : কওমি শিক্ষক, লেখক ও বিভাগীয় সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর
বিকেপি/