শীত আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রতিটি ঋতুর মতো শীতকালও নিজস্ব রূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয়। শীতকালে প্রকৃতি সাজে নতুন রূপে। বাগ-বাগিচা সমৃদ্ধ হয় ফল-ফুলে। মাঠ-ঘাট ছেয়ে যায় শাক-সবজি-ফসলে। এমন মুগ্ধকর ঋতুকে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে মুমিন বান্দার জন্য ইবাদতের বসন্তকাল। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘শীতকাল মুমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১১৬৫৬)
শীতে দিন ছোট, রাত বড়। ফলে অবসর সময়ও গ্রীস্মের তুলনায় বেশি থাকে। তাই শীতের রাতে মুমিনের মহান প্রভুর দরবারে নিজেকে সঁপে দেওয়ার অবারিত সুযোগ। হাদিসে শীতকালে বরকত থাকার ব্যাপারটি উল্লেখ রয়েছে। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলতেন, ‘শীতকালকে স্বাগতম। কেননা, তা বরকত বয়ে আনে। শীতের রাত দীর্ঘ হয়, যা কিয়ামুল লাইলের (রাতের নামাজ) সহায়ক এবং দিন ছোট হওয়ায় রোজা রাখা সহজ।’ (শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকি : ৩৯৪০)
এই শীতেই আমাদের আশপাশে আয়োজন করা হয় অসংখ্য ওয়াজ মাহফিলের। মুসলিম জীবনযাপনের সারাবছরের খোরাকের অনেকখানি এই শীতের ওয়াজ মাহফিল থেকেই ‘বিতরণ’ করা হয়। ওয়াজকে আরও কয়েকটি নামে ব্যক্ত করা যায়— নসিহত, বয়ান, খুতবা ইত্যাদি। শাব্দিক অর্থ- উপদেশ। ওয়াজ দাওয়াতের প্রচলিত মাধ্যমগুলোর অন্যতম। ওয়াজ ও নসিহতের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার রাসুল (সা.)-এর অন্যতম একটি সুন্নত। আল্লাহ তায়ালা রাসুল (সা.)-কে ওয়াজের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেন, ‘তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর ওয়াজের (উপদেশ) মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১২৫)
ওয়াজ-নসিহতের ফজিলত সম্পর্কিত আরো একাধিক আয়াত ও অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এসবের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামের শুরুকাল থেকে আজ অবধি ওলামায়ে কেরাম বিভিন্নভাবে ওয়াজ-নসিহত করে মানুষের মধ্যে দ্বীনের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষ কিভাবে তাদের ঈমান-আকাইদ, ইবাদত-বন্দেগি, লেন-দেন পরিচালনা করবেন এবং আখলাক-চরিত্র গঠন করবেন ওয়াজের মাধ্যমে আলেমরা সেইসব বিষয়সহ তাদের সামনে ইসলামের সার্বিক হুকুম-আহকাম তুলে ধরছেন।
আর রাসুল (সা.)-এর যুগ থেকে শুরু করে তৎপরবর্তী ওলামায়ে কিয়ামের ওয়াজ ও নসিহতে ছিল অভাবনীয় প্রভাব। নিকট অতীতে আলেমদের ওয়াজ ও নসিহতও ছিল ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিকারী। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো- সম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াজ মাহফিলের সংখ্যা ও আড়ম্বরতা সীমাহীন বৃদ্ধি পেলেও সমাজে তার প্রভাব শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ক্ষেত্র বিশেষ বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। কিন্তু কেন এমনটি হলো?
এ বিষয়ে রাজধানীর মগবাজারে অবস্থিত হজরত শাহ নূরী (রহ.) জামে মসজিদের খতিব ও ডেমরার দারুন নাজাত মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ছানাউল্লাহ জামালী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বর্তমান যুগে ওয়াজের শ্রোতা পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ইউটিউব, ফেসবুকসহ ডিজিটাল মাধ্যমে অধিক পরিমাণে ওয়াজ শ্রবণের পরও আমাদের সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে এর খুব একটা প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছে না। কারণ, অনেকে ওয়াজ এখন জ্ঞানার্জনের বদলে বিনোদনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করছেন। পাশাপাশি ওয়াজের ময়দানে আলোচনার চেয়ে সমালোচনা বেশি হয়। শ্রোতারাও ইসলাহী আলোচনার চেয়ে এখতেলাফি আলোচনা বেশি পছন্দ করেন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান শ্রোতাদের বক্তার কণ্ঠ, আবেগ ও নাটকীয়তা আকর্ষণ করে, কিন্তু তাতে তাদের হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে না। ইসলামের বাণী কেবল শোনার নয়, তা বোঝা, আত্মসমালোচনা করা এবং জীবনে প্রয়োগ করাই আসল উদ্দেশ্য। যতক্ষণ না ওয়াজ আমাদের কর্মে ও চরিত্রে প্রভাব ফেলে, ততক্ষণ তার প্রকৃত ফল মিলবে না।
মাওলানা ছানাউল্লাহ জামালীর মতে- ওয়ায়েজিন ও বক্তাদের আলোচনায় ইসলামে পরকাল, মানবতা, ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধে দ্বীনী শিক্ষার মূলনীতিগুলো বেশি প্রচার করতে হবে। তাহলেই কেবল ওয়াজের প্রভাবের মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক পরিবর্তন ও একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
তবে প্রভাব সৃষ্টিকারী ওয়াজের জন্য বক্তাদের বিশেষকিছু পরামর্শ দিয়েছেন জিয়াউল উলুম ঢাকার মুহতামিম ও বরেণ্য আলেম মুফতি রেজাউল হক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। তার মতে- বক্তাদের মধ্যে সেসব গুণ থাকলে তাদের ওয়াজ আরো প্রভাব সৃষ্টিকারী হবে। তিনি বলেন, কুরআনুল কারিম ও হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে ওয়াজ-নসিহত ও উপদেশ দানের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত দিকনির্দেশনা রয়েছে। প্রথমত, যিনি ওয়াজ ও নসিহত করবেন, তার মধ্যে নিন্মোক্ত গুণাবলী থাকতে হবে—
১. যিনি ওয়াজ ও নসিহত করবেন তার দ্বীনি শিক্ষা, আত্মশুদ্ধি, চরিত্র ও নৈতিকতার ব্যাপারে সমকালীন সর্বজনমান্য জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত ওলামায়ে কিয়ামের পূর্ণ আস্থা থাকতে হবে।
২. যিনি ওয়াজ ও নসিহত করবেন তিনি কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য ওয়াজ করবেন। অর্থ কড়ি, হাদিয়া তোহফা, জশ-খ্যাতি ও লৌকিকতা তথা সকল পার্থিব মোহ থেকে মুক্ত হবে।
৩. ওয়াজ ও নসিহতের জন্য উত্তম পন্থা অবলম্বন করতে হবে; ভাষা কোমল, মাধুর্যময় ও শালীন হতে হবে।
৫ ওয়াজ ও নসিহতের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা ওয়াজ ও নসিহত শুনবেন তারা আমলের নিয়্যতে শুনবেন।
তত্ত্বজ্ঞানীদের উদ্ধৃতি দিয়ে মুফতি রেজাউল হক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ওয়াজ ও নসিহত প্রভাব সৃষ্টি না করার অন্যতম প্রধান কারণ হলো- কাসওয়াতুল ক্বলব (হৃদয় পাথরের মতো) শক্ত হয়ে যাওয়া অথবা মওতুল ক্বলব (হৃদয়ের মরণ সাধন)। এজন্য আমাদের হৃদয়কে সজিব রেখে ওয়াজ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত রাখা খুবই জরুরি।
ওয়াজ মাহফিল নিয়ে দারুণ একটি ঘটনা
হজরত শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.) উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত আলেম ও মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি একদিন দিল্লির জামে মসজিদে ওয়াজ করেছিলেন। দীর্ঘ ওয়াজ। ওয়াজ শেষে যখন তিনি সিঁড়ি ভেঙে নামতে যাচ্ছেন, এমন সময় দেখা গেল, গ্রাম্য এক লোক দৌড়ে এসে হাঁপাতে লাগল। হজরত শাহ সাহেবকেই লোকটি জিজ্ঞেস করল, মৌলভী ইসমাঈলের ওয়াজ কি শেষ হয়ে গেছে?
তিনি উত্তরে জানালেন, হাঁ ভাই, শেষ। লোকটি তখন আক্ষেপ করে বলল, আমি তো তার ওয়াজ শোনার জন্যই দৌড়ে এসেছি। হজরত ইসমাঈল শহীদ (রহ.) তখন লোকটির কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনি আমার সামনে এই সিঁড়িতে বসে পড়ুন, আমি আপনাকে পূর্ণ ওয়াজ শুনিয়ে দিচ্ছি। এরপর তিনি সেই দীর্ঘ ওয়াজ আবার এই একজনকে শুনিয়ে দিলেন।
উপস্থিত লোকেরা অবাক হয়ে জানতে চাইল, শুধু একজনের জন্য এত দীর্ঘ ওয়াজ করলেন? তিনি উত্তরে বললেন, প্রথমবার যে ওয়াজ করেছিলাম তা তো ‘একজনের’ জন্যই করেছিলাম, এখন যা করেছি তাও ‘একজনের’ জন্যই করেছি। ওই ‘একজনের’ (আল্লাহ) সন্তুষ্টিই ছিল তাদের কাছে ওয়াজের সফলতার মানদণ্ড।
সুতরাং আমাদেরও ওই ‘একজনের’ সন্তুষ্টির জন্যই ওয়াজ করতে হবে এবং শুনতে হবে। তাহলেই ওয়াজ মাহফিলের আগের সেই প্রভাব ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ!
আইএইচ/


