বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসে কওমি মাদরাসা এক অনন্য ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। এই শিক্ষাব্যবস্থা মূলত ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে জন্ম নেয়। ব্রিটিশদের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির ফলে যখন ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়ে তখনই ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয় এক বিকল্প ইসলামী শিক্ষা আন্দোলন। সেই ধারাতেই ভারত পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার বিস্তার ঘটে।
দীর্ঘ সময় ধরে এই মাদরাসাগুলো কুরআন-হাদীস, ফিকহ-তাফসির আরবি ভাষা ও ইসলামী আদর্শ প্রচারে অসামান্য ভূমিকা পালন করছে। দেশের গ্রামগঞ্জে ধর্মীয় জ্ঞান নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার যে আলো আজও জ্বলজ্বল করছে তার একটি বড় অংশই এসেছে কওমি মাদরাসা থেকে।
কওমি মাদরাসা ও সময়ের পরিবর্তন
কওমি মাদরাসা কেবল ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র নয় এটি মুসলিম সমাজের নৈতিক চরিত্র গঠনের মূল ভিত্তি। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বিশ্বব্যবস্থা প্রযুক্তি যোগাযোগ ও পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। এখন একজন আলেম বা শিক্ষক কেবল মসজিদ বা মাদ্রাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নন তাঁকে সমাজে নেতৃত্ব দিতে হয় মানুষকে দাওয়াত দিতে হয় এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসরেও ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতে হয়।
এই বাস্তবতায় কওমি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা যুগোপযোগী পাঠদানের কৌশল ও সামাজিক নেতৃত্বে পিছিয়ে পড়ছেন। তাই সময় এসেছে কওমি শিক্ষায় মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রত্যেক বড় মাদ্রাসায় ‘ইসলাহ ট্রেনিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার যা হবে শিক্ষক উন্নয়ন নৈতিকতা ও আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতির সমন্বিত কেন্দ্র।
শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা উন্নয়ন
একজন শিক্ষক মাদরাসার প্রাণশক্তি। তাঁর জ্ঞান যত গভীরই হোক যদি শিক্ষাদানের পদ্ধতি একঘেয়ে বা অনুপ্রেরণাহীন হয় তবে ছাত্ররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ইসলাহ ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে শিক্ষকরা শিখতে পারবেন কীভাবে পাঠদানকে আকর্ষণীয় ও ফলপ্রসূ করা যায় কীভাবে শিক্ষার্থীর মনোযোগ ধরে রাখা যায় এবং কীভাবে শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ব্যবহার করে ছাত্রদের চিন্তাশক্তি বিকাশ করা সম্ভব। এতে শিক্ষকরা আত্মবিশ্বাসী হবেন পাঠের মান উন্নত হবে এবং শিক্ষার্থীরাও জ্ঞান ও নৈতিকতার সমন্বয়ে বেড়ে উঠবে।
ইসলাহ ট্রেনিং সেন্টার নৈতিকতা ও মানবিকতার পাঠশালা
ইসলাহ অর্থ সংশোধন বা আত্মশুদ্ধি। তাই ইসলাহ ট্রেনিং সেন্টার হবে শুধু পাঠদানের কৌশল শেখার জায়গা নয় বরং নৈতিকতা মানবিক গুণাবলি ও চরিত্র গঠনের এক বাস্তব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে শিক্ষকদের শেখানো হবে কীভাবে নিজেদের আচরণ ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করা যায় কিভাবে সহমর্মিতা বিনয় ন্যায়পরায়ণতা ও দায়িত্ববোধকে শিক্ষা জীবনের অংশ করা যায়।
ফলে একজন শিক্ষক কেবল তথ্যের বাহক হবেন না। তিনি হয়ে উঠবেন আদর্শ ও নৈতিকতার জীবন্ত প্রতীক। এই ধরনের প্রশিক্ষণ কওমি শিক্ষকদেরকে কেবল পাঠদাতা নয় বরং সমাজের নেতৃত্বদাতা ও সংস্কারক মুসলিহ হিসেবে গড়ে তুলবে।
পাঠদানে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির সংযোজন
বিশ্বের ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যেই মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও ডিজিটাল টুল ব্যবহার করছে। কওমি মাদরাসার শিক্ষকরা যদি মৌলিক কম্পিউটার জ্ঞান প্রেজেন্টেশন দক্ষতা এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শেখেন তবে পাঠদান আরও জীবন্ত ও আকর্ষণীয় হবে। ইসলাহ ট্রেনিং সেন্টারে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ চালু করলে শিক্ষকরা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইসলামী জ্ঞান আরও কার্যকরভাবে প্রচার করতে পারবেন।
দাওয়াতি ও সমাজসেবামূলক দক্ষতা অর্জন
একজন কওমি শিক্ষক সমাজে দাওয়াতি ও নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক। তাই তাঁকে কেবল পাঠদানেই নয় যোগাযোগ বক্তৃতা সামাজিক নেতৃত্ব ও দাওয়াতি পদ্ধতিতেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। ইসলাহ ট্রেনিং সেন্টারের বিশেষ কোর্সে এসব দক্ষতা শেখানো হলে শিক্ষকরা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রদূত হয়ে উঠবেন।
আত্মনির্ভরতা ও কর্মক্ষেত্রের বিস্তার
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক কেবল মাদরাসা নির্ভর নয় তিনি গবেষণা অনুবাদ ইসলামিক মিডিয়া সমাজবিজ্ঞান বা প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও কাজ করতে পারবেন। এতে শিক্ষকদের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হবে এবং সমাজে কওমি শিক্ষার মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়
কেউ কেউ মনে করেন প্রশিক্ষণ মানে কওমি ধারাকে পরিবর্তন করা কিন্তু আসলে এটি ইসলামী ঐতিহ্যের শক্ত ভিত্তিকে আরও দৃঢ় করার প্রয়াস। সাহাবায়ে কিরাম শুধু ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন না তাঁরা যুদ্ধনীতি প্রশাসন বাণিজ্য ও সমাজসেবায়ও প্রশিক্ষিত ছিলেন। তাঁদের জীবন থেকেই বোঝা যায় ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে বাস্তব দক্ষতার সমন্বয়ই ইসলামের পূর্ণতা আনে।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও উদ্যোগ
প্রত্যেক বড় মাদরাসা যদি নিজেদের অধীনে একটি ইসলাহ ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তোলে যেখানে নতুন ও পুরাতন শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কোর্স থাকবে তাহলে তা পুরো কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এছাড়া কওমি বোর্ড চাইলে একটি কেন্দ্রীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে পারে যা সারাদেশের মাদরাসাগুলোর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তদারক করবে। এতে শিক্ষাদানে একধরনের ঐক্য পেশাদারিত্ব ও মানোন্নয়ন আসবে।
কওমি মাদরাসা আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য নৈতিকতা ও জাতিগত মূল্যবোধের ধারক। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে কেবল ঐতিহ্যের জোরে টিকে থাকা যথেষ্ট নয় প্রয়োজন সময়োপযোগী দক্ষতা ও সচেতনতা। শিক্ষকদের জন্য ইসলাহ ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা কওমি শিক্ষাকে কেবল আধুনিক করবে না বরং এটিকে সমাজে আরও প্রভাবশালী আত্মনির্ভর ও সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে।
আজ যদি প্রতিটি মাদরাসা শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় তবে আগামী প্রজন্মের শিক্ষা আরও আলোকিত হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক : প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ, দশমিনা ইসলামিয়া কামিল এমএ মাদ্রাসা, পটুয়াখালী, বরিশাল।
বিকেপি/এমবি

