ইতিহাসের দীর্ঘ অধ্যায়ে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন। যাদের চিন্তা, দর্শন ও আত্মিক অনুধাবন মানবসভ্যতার গতিপথকেই বদলে দিয়েছে। তাদের কেউ ছিলেন রাজনীতির মঞ্চে, কেউ দর্শনের পরিমণ্ডলে, কেউবা ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার দিগন্তে। কিন্তু যিনি এই তিন ক্ষেত্রেরই এক অনন্য সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ইসলামী চিন্তার এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি হলেন ইমাম আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ আল গাযালী। যিনি ইতিহাসে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বা ইসলামের দলিল নামে খ্যাত।
ইমাম গাযালী ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পারস্যের তুস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন এক দরিদ্র কিন্তু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, যিনি স্বপ্ন দেখতেন তার সন্তান যেন জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়। পিতার মৃত্যুর পর এক সুফি বন্ধুর তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন গাযালী, আর সেখানেই প্রথম বীজ পড়ে তার অন্তর্র্দশনের, সেই আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের যা পরবর্তী জীবনে তাকে সুফিবাদের এক অমর প্রতীক করে তোলে। শৈশব থেকেই অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। খুব অল্প বয়সেই তিনি কুরআন, হাদিস, আরবি সাহিত্য, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ও ফিকহে (ইসলামী আইনশাস্ত্র) পারদর্শিতা অর্জন করেন। তার শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় নিসাপুরে, যেখানে তিনি অধ্যয়ন করেন ইমাম আল-জুয়াইনির নিকট যিনি ছিলেন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ও চিন্তাবিদ। আল-জুয়াইনির তত্ত্বাবধানে গাযালী ইসলামি আইন, দর্শন, তর্কবিদ্যা ও কালামের গভীরতম স্তরে প্রবেশ করেন।
গাযালীর মেধা ও যুক্তির প্রখরতা এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নিসাপুরে হয়ে ওঠেন আল-জুয়াইনির প্রিয়তম শিষ্য এবং উত্তরসূরি। জ্ঞান ও বাগ্মিতার এমন জৌলুসে তিনি দ্রুতই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সেলজুক সাম্রাজ্যের শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী নিযামুল মুলকের। নিযামুল মুলক ছিলেন জ্ঞানানুরাগী ও প্রজ্ঞাবান রাষ্ট্রনায়ক, যিনি মুসলিম জগতে শিক্ষা ও বৌদ্ধিক পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অসংখ্য মাদরাসা। গাযালীকে তিনি আহ্বান জানান বাগদাদের বিখ্যাত নিযামিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনার জন্য। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে গাযালী সেখানে প্রধান অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান যা সে সময়ের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বৌদ্ধিক পদ ছিল। বাগদাদে অবস্থানকালে গাযালী ইসলামী চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তার চারপাশে সমবেত হয়েছিলেন শত শত ছাত্র, জ্ঞানপিপাসু ও রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতা। তিনি ছিলেন যেমন যুক্তির জাদুকর, তেমনি নৈতিকতার সংস্কারক।
কিন্তু জীবনের এই শীর্ষবিন্দুতেই শুরু হয় তার অন্তর্দ্ব›েদ্বর সূচনা। বাহ্যিক সাফল্যের আড়ালে তিনি অনুভব করছিলেন গভীর এক শূন্যতা। বিদ্যা, খ্যাতি, বিতর্ক সবই যেন এক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছিল তার মনে। তিনি উপলব্ধি করলেন, জ্ঞানের অহঙ্কার মানুষের আত্মাকে শুষে নেয় যদি তা আল্লাহর ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে সংযুক্ত না থাকে। এই অন্তর্দহন থেকেই শুরু হয় গাযালীর আত্মশুদ্ধির যাত্রা। একদিন তিনি হঠাৎ সব ছেড়ে দেন। তার পদ, মর্যাদা, সম্পদ, এমনকি পরিবারও। বাগদাদ থেকে তিনি নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়েন এক অজানা পথে, শুধু সত্যের সন্ধানে। প্রায় এক দশক তিনি নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন, কখনও দামেস্কের মসজিদে ধ্যান করেন, কখনও জেরুজালেমের গম্বুজের ছায়াতলে আত্মমগ্ন হন। আবার কখনও মক্কার পথে পাড়ি জমান। এই সময়েই তার চিন্তা রূপ নেয় তাসাউফ বা সুফিবাদের দার্শনিক রূপে। গাযালীর সুফিবাদ ছিল আত্মানুশীলনের এক শুদ্ধ পথ। যেখানে হৃদয় ও জ্ঞানের সমন্বয়ে মানুষ আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছায়।
তিনি সুফিবাদকে কোনো গোপন সাধনা বা রহস্যবাদে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং যুক্তি, নৈতিকতা ও শরিয়াহর মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। তার মতে, জ্ঞানের তিনটি স্তর রয়েছে, ইলমুল ইয়াকিন (জানার জ্ঞান), আইনুল ইয়াকিন (দেখার জ্ঞান) ও হাক্কুল ইয়াকিন (অভিজ্ঞতার জ্ঞান)। এই শেষ স্তরেই মানুষ আল্লাহকে অনুভব করে, যা কেবল তাসাউফের মাধ্যমে সম্ভব। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন’ (ধর্মজ্ঞান পুনরুজ্জীবন) মুসলিম আত্মিক জীবনের শ্রেষ্ঠ সংকলন হিসেবে বিবেচিত। এই বইয়ে তিনি শরিয়াহ, নৈতিকতা, মনোবিজ্ঞান, সামাজিক আচরণ, আত্মসংযম ও আল্লাহপ্রেম সবকিছুকে এমনভাবে একত্র করেছেন, যা আজও মুসলিম সমাজে আত্মশুদ্ধির দিশারি।
সুফিবাদের জগতে গাযালীর অবদান ছিল বিপ্লবাত্মক। তিনি সুফিবাদকে শুধু আধ্যাত্মিক সাধনার গণ্ডি থেকে বের করে এনে এক জীবনদর্শনে রূপ দেন। তার তাসাউফ ছিল সমাজমুখী, নৈতিকতাভিত্তিক ও বৌদ্ধিকভাবে সংহত। তিনি বলেছিলেন, সত্যিকারের সুফি সেই, যিনি জ্ঞান ও প্রেমের মিশ্রণে মানুষ ও আল্লাহর মধ্যে সেতু গড়ে তোলেন। গাযালী সুফিবাদকে কোরআন ও সুন্নাহর মর্মে ভিত্তি করে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, মানুষের হৃদয় যদি পবিত্র না হয়, তাহলে জ্ঞানের সব অর্জনই বৃথা। এই চিন্তাধারা আজও ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তি হয়ে আছে।
ইমাম গাযালী কেবল ধর্মীয় চিন্তাবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন সমাজসংস্কারকও। তার শিক্ষায় জোর দেওয়া হয়েছে আত্মসমালোচনা, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও আত্মনিবেদন-এর ওপর। এই শিক্ষাই উপমহাদেশে সুফি আন্দোলনের বীজ রোপণ করে। ভারতের খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (রহ), শাহ জলাল (রহ), শাহ পরান (রহ)-সহ অসংখ্য সুফি গাযালীর চিন্তা থেকে অনুপ্রাণিত হন। তাদের প্রচারিত ইসলাম ছিল শান্তি, আল্লাহপ্রেম ও মানবতার ইসলাম যা আজও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চেতনায় গভীরভাবে গাঁথা।
ইমাম গাযালীর প্রভাব উপমহাদেশে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দিল্লির প্রাচীন পাঠাগার ও মাদরাসাগুলোতে তার গ্রন্থগুলো পাঠ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মুঘলসম্রাট আওরঙ্গজেব পর্যন্ত তার চিন্তায় প্রভাবিত ছিলেন। বাংলার সুফি সাধকরা তার দর্শনকে সমাজ সংস্কার ও ধর্মীয় সহনশীলতার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেট ও পঞ্চগড়ের প্রাচীন খানকাগুলোয় আজও গাযালীর গ্রন্থ পাঠ করা হয় আত্মিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে। তিনি এমন এক সেতু তৈরি করেছিলেন, যেখানে জ্ঞান ও প্রেম, যুক্তি ও বিশ্বাস, মন ও আত্মা মিলেমিশে যায় এক মহত্তর ঐক্যে। গাযালীর মৃত্যুর সময়ও ছিল তেমনি শান্ত ও নিস্তব্ধ। ১১১১ খ্রিস্টাব্দে, এক সকালে তিনি নিজ হাতে কাফনের কাপড় প্রস্তুত করে নামাজ আদায় করেন, কিছুক্ষণ পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুর পরও তার চিন্তা টিকে আছে কোটি মানুষের হৃদয়ে। আজও তার লেখা ‘ইহইয়া’ খুললে মনে হয় যেন শতাব্দী পেরিয়েও সেই প্রজ্ঞার আলো নিভে যায়নি। ইমাম গাযালী প্রমাণ করেছিলেন সত্যিকারের জ্ঞান কেবল মাথায় নয়, হৃদয়ে জন্ম নেয়। আর হৃদয়ের জ্ঞানই মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে যায়।
গাযালীর দর্শন থেকে আমরা পাই আল্লাহকে খুঁজতে হলে নিজেকে খুঁজতে হবে, নিজের অহঙ্কার ভাঙতে হবে। সত্যের পথে হাঁটা মানে নিঃস্বার্থ হওয়া, জ্ঞানের পথে বিনয়ী থাকা।
তিনি বলেছিলেন, ‘যে নিজের আত্মাকে চিনে, সেই তার রবকে চিনে।’ এই এক বাক্যেই যেন তার সমগ্র দর্শনের সারসংক্ষেপ নিহিত। এ ছিল এক এমন দর্শন, যা কেবল মুসলমান নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য এক আলোকবার্তা। ইমাম গাযালীর জীবন যেন এক অনন্ত অনুসন্ধান- জ্ঞানের, সত্যের, ভালোবাসার। তিনি দেখিয়েছিলেন, মানুষ যদি নিজের ভেতরের অন্ধকার জয় করতে পারে, তবেই সে আলোকিত হয়। আর সেই আলোকিত মানুষই সমাজ, সভ্যতা ও ধর্মকে অর্থবহ করে তোলে। তাই শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও ইমাম গাযালী আজও বেঁচে আছেন তার চিন্তায়, তার লেখায়, তার নিঃশব্দ ধ্যানে। তিনি যেন এক চিরন্তন আহ্বান, ফিরে যাও নিজের ভিতরে, যেখানে লুকিয়ে আছে আল্লাহর আলো।
লেখক : কলামিস্ট, এমফিল গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ। sultanmh17@gmail.com
বিকেপি/এমবি

