শব্দদূষণ প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:০৬
শব্দদূষণ একধরনের মারাত্মক পরিবেশদূষণ। আমাদের সঠিক অনুধাবনের অভাবে দিন দিন এই দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। তাই দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে শব্দ। আলো, তাপ, বিদ্যুৎ এবং চুম্বকের মতো শব্দও এক প্রকার শক্তি। বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন জোরালো এবং অপ্রয়োজনীয় শব্দ যখন মানুষের সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে বিরক্তির সৃষ্টি হয় সে অবস্থাকেই বলা হয় শব্দদূষণ। আর বাংলাদেশে দূষণের শেষ নেই। পরিবেশ, বায়ু, পানি, নদী সবকিছুই দূষিত হচ্ছে। দূষণে দূষণে নগরজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। শব্দদূষণ এখন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শহুরেরা শব্দদূষণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। শব্দদূষণের শিকার সর্বশ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষ।
জরিপ মতে শব্দদূষণের কারণে বাংলাদেশে ২৩টি রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু নগর নয়, গ্রামও শব্দদূষণে দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারণ, গ্রামগুলো দ্রুত নগরে পরিণত হচ্ছে। শহরের ভালো-মন্দ সবকিছুই গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামেও শব্দদূষণ হচ্ছে সমানতালে। পঁচাত্তর ডিসিবেলের চেয়ে উচ্চগতির শব্দ মানুষের সহনীয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে না। যত বিকট শব্দ তত বড় রোগের সৃষ্টি হচ্ছে বলে চিকিৎসকগণের মতামত রয়েছে। এ শব্দদূষণ হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। গাড়ির হর্ন, ঢোল-তবলার আওয়াজ, মিল-কারখানার শব্দ, মাইকের আওয়াজ, সাউন্ড সিস্টেম, বিমানের আওয়াজ, পণ্যের বাণিজ্যিক প্রচার ইত্যাদির কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে। তন্মধ্যে মাইকের ব্যবহারের কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় ইত্যাদি অনুষ্ঠানে মাইক ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার হচ্ছে। বিয়ে-শাদি, পূজা-অর্চনা, মিছিল-মিটিংয়ে মাইকের পাশাপাশি ঢোল-তবলাসহ আধুনিক বাদ্য ও শব্দযন্ত্রের অধিক ব্যবহারের কারণেও শব্দদূষণ হচ্ছে। শব্দদূষণ যে কারণে বা যেভাবেই হোক না কেন, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে তা বন্ধ করতে হবে। যেসব ভালো ও উন্নয়নমূলক কাজে মাইক বা শব্দযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে সেগুলোতেও সংস্কার ও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
ইতিমধ্যে সবকিছুতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এবং পরিবর্তন এসেছে। শব্দযন্ত্র ব্যবহারেও পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষত ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মিলাদ মাহফিল, পূজা-অর্চনাতে মাইক ও শব্দযন্ত্র ব্যবহার করতে হবে সচেতনভাবে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যদি শব্দদূষণ বা অশান্তি সৃষ্টি হয় সেটি মানুষের বিবেকে বেশি আঘাত লাগে। কারণ, ধর্মের মূলবাণী মানুষের কল্যাণ, শান্তি, শৃংখলা ও উন্নতি। কাউকে কষ্ট দিয়ে ধর্মপ্রচার, ধর্মীয় বাণী শুনানো বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা ধর্মীয় বিধানেই নিষিদ্ধ। বিশেষত পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ মোটেই সেটি অনুমোদন করে না।
ওয়াজ মাহফিল, পূজা-অর্চনাতে অপ্রয়োজনীয় মাইক বা শব্দযন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশের জনসংখ্যা বাড়ার কারণে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জার সংখ্যা ও আকার বেড়েছে। জমায়েত অনুসারে ধর্মীয় বাণী শুনার জন্য মাইকের ব্যবহার প্রয়োজন। যেমন মুসলমানরা জুমার দিন সাপ্তাহিক বড় জমায়েতে শরিক হয়ে জুমার খুতবা শুনেন। অনেক মসজিদে মাইকের ব্যবহার বা সাউন্ডবাক্সের প্রয়োজন হয়। এভাবে অনেক ধর্মীয় উপসনালয়ে মাইকের প্রয়োজন হতে পারে। উপস্থিত সমাবেশের জন্য যতটুকু আওয়াজের প্রয়োজন, ততটুকু ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্টরা যেমন অধিকার বঞ্চিত হবে না। তেমনি অন্যদের কাজ, ঘুম, লেখাপড়া ইত্যাদিতে ব্যাঘাত ঘটবে না। মুসলিম হওয়ার মাপকাঠিই নির্ধারণ করেছে জিহ্বা দ্বারা তথা কটু কথা বা উচ্চ আওয়াজ করে মানুষকে কষ্ট দেয়া না দেয়ার ওপর। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘প্রকৃত মুসলিম সে-ই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।’ (বোখারি : ১০)।
নিম্নস্বরে কথা বলার মাধ্যমে শব্দদূষণ রোধ করা সম্ভব। যেমন যখন কথা বলবে তখন উঁচু গলায় কথা না বলে নিম্নস্বরে কথা বলবে, তখন তার দ্বারা পরিবেশ দূষণ অনেকাংশে রক্ষা পাবে। পরিবেশ দূষণরোধে আল্লাহ নামাজের মতো ইবাদাতেও স্বর উঁচু না করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা সালাতে স্বর উচ্চ করো না এবং অতিশয় ক্ষীণও করো না; এই দুইয়ের মাঝ পথ অবলম্বন করো।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১১০)
আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা চুপি চুপি করার জন্য পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাকো কাকুতি-মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৫৫)।
আয়াতে কারিমায় চুপিচুপি ও সংগোপনে দোয়া করা উত্তম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং আয়াতের শেষে এ বিষয়ে সতর্কও করা হয়েছে যে, দোয়া করার ব্যাপরে সীমা অতিক্রম করা যাবে না। কেননা, আল্লাহতায়ালা সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা যাকারিয়া (আ.) এর দোয়া উল্লেখ করে বলেন, ‘যখন সে তার পালনকর্তাকে অনুচ্চস্বরে ডাকল।’ (সুরা মারইয়াম : ৩) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো, তোমার আওয়াজ নিচু করো, নিশ্চয়ই সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হলো গাধার আওয়াজ।’ (সুরা লুকমান : ১৯)
একইভাবে মানুষের জন্য এমনভাবে গৃহনির্মাণ করা জায়েজ নয়, যা অন্যের বসবাসের জন্য হুমকি হতে পারে। তেমনি টেলিভিশন, রেডিও ইত্যাদির অতিমাত্রায় আওয়াজ করাও বৈধ নয়। কারণ তা প্রতিবেশীর শান্তি বিনষ্ট করে। উচ্চ স্বরে ডাকাডাকি, চিৎকার, দোয়া ও জিকিরের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা সম্পর্কিত উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইসলাম শব্দদূষণের ব্যাপারে কতটা সতর্ক।
পরিশেষে বলতে চাই, শব্দ দূষণরোধে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ ও বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন হওয়া শব্দ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কাজ করতে আগ্রহী, আশা করি তারাও এ প্রতিবেদন থেকে লাভবান হবেন। আমি মনে করি জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ঐক্যবদ্ধ কর্ম প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত দিক নির্দেশনা শব্দদূষণকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।
লেখক: সংগঠক ও কলাম লেখক
drmazed96@gmail.com
বিকেপি/এমবি

