Logo

ধর্ম

আল্লামা ইকবাল (রহ.) প্রেরণার কবি, মহাকালের কবি

Icon

সুলতান মাহমুদ সরকার

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:২০

আল্লামা ইকবাল (রহ.) প্রেরণার কবি, মহাকালের কবি

ইতিহাসের কিছু মহানায়ক থাকেন যারা শুধু কালের সন্তান নন, তারা সময়েরও ঊর্ধ্বে। তাদের চিন্তা ও দর্শন মহাকালের স্রোতে পরিণত হয়ে পরবর্তী যুগকে প্রভাবিত করে, প্রেরণা দেয়, জাগিয়ে তোলে অচেতন জাতিকে। এমন এক অনন্য ব্যক্তিত্বের নাম আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল। তিনি ছিলেন এমন এক কবি, যিনি শুধু শব্দে নয়, আত্মায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তার কবিতার প্রতিটি পঙক্তি, প্রতিটি আহ্বান যেন ঘুমন্ত জাতির আত্মায় বিদ্যুতের ঝলক এনে দিয়েছে। তিনি ছিলেন ইসলামি জাগরণের অগ্রদূত, মুসলিম উম্মাহর চেতনার দিকনির্দেশক, আত্মমর্যাদার পুনর্জাগরণের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তার জীবন, চিন্তা, দর্শন ও সাহিত্য এক অনন্ত প্রেরণার উৎস যা আজও মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ভূমিতে চির অম্লান।

১৮৭৭ সালের ৯ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের সিয়ালকোটে জন্ম নেন এই মহান ব্যক্তিত্ব। তার পরিবার ছিল ধর্মপ্রাণ ও শিক্ষানুরাগী। পিতা শেখ নূর মোহাম্মদ ছিলেন এক পরহেজগার, নীরব সাধকপ্রাণ মানুষ, যিনি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহর স্মরণে বিভোর থাকতেন। মাতা ইমাম বিবি ছিলেন ধৈর্যশীলা ও স্নেহময়ী নারী, যিনি সন্তানদের মধ্যে নৈতিকতা, মমতা ও ঈমানের বীজ রোপণ করেছিলেন। এমন এক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ইকবাল ছোটবেলা থেকেই ছিলেন চিন্তাশীল ও মননপ্রবণ। তার শিক্ষার শুরু স্থানীয় মক্তবে, যেখানে তিনি কুরআন তিলাওয়াত ও ইসলামি শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ নেন। পরবর্তীতে তিনি সিয়ালকোটের Scotch Mission College-G-এ ভর্তি হন, যেখানে তার মেধা ও বুদ্ধিমত্তা সকলকে মুগ্ধ করে। এখানেই তিনি ইংরেজি, দর্শন ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। অল্প বয়সেই তার চিন্তার পরিধি বিস্তৃত হতে শুরু করে, তিনি উপলব্ধি করতে থাকেন যে, মুসলিম জাতি কেবল রাজনৈতিক নয়, আত্মিক ও বৌদ্ধিক দিক থেকেও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।

লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি অধ্যাপক টমাস আর্নল্ডের সান্নিধ্য লাভ করেন, যিনি ইকবালের জীবনের অন্যতম প্রভাবক হয়ে ওঠেন। আর্নল্ডের দিকনির্দেশনায় ইকবাল পাশ্চাত্য দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হন, বুঝতে পারেন যুক্তিবাদী চিন্তার গুরুত্ব, কিন্তু একই সঙ্গে উপলব্ধি করেন যে, কেবল বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে মানুষের আত্মিক শূন্যতা পূর্ণ করা যায় না। মানুষের জীবনকে আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে সংযুক্ত না করলে জ্ঞানের আলোও অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এই উপলব্ধিই ইকবালের চিন্তার মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

১৯০৫ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল “The Development of Metaphysics in Persia”- যেখানে তিনি ইসলামি দার্শনিক ঐতিহ্যের বিকাশ বিশ্লেষণ করেন। ইউরোপে অবস্থানকালে তিনি একদিকে যেমন পশ্চিমা সভ্যতার অগ্রগতি ও জ্ঞানের বিকাশে মুগ্ধ হন, অন্যদিকে তেমনি দেখেন সেই সভ্যতার আত্মিক দারিদ্র্য ও নৈতিক অধঃপতন। এই দ্বৈত অভিজ্ঞতা তাকে নতুন করে ভাবতে শেখায় কীভাবে ইসলামের জীবনবোধ ও চেতনা আধুনিক চিন্তার সঙ্গে সমন্বিত হতে পারে।

পাশ্চাত্যে অবস্থান করেও ইকবাল কখনো ইসলামের মৌলিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। বরং তিনি বারবার বলেছিলেন, “ইউরোপের উন্নতি তার জ্ঞান ও বিজ্ঞানে, কিন্তু তার পতনের বীজও সেখানে, কারণ তাদের হৃদয় আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন।” এই বক্তব্য তার চিন্তার সারমর্ম প্রকাশ করে। তিনি শিখেছিলেন জ্ঞান, কিন্তু সেই জ্ঞানকে ইসলামি চেতনার আলোয় ব্যাখ্যা করেছেন। তার দৃষ্টিতে ইসলাম ছিল এক গতিশীল সভ্যতা, যেখানে যুক্তি, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা মিলেমিশে এক হয়।

ইকবালের খ্যাতির মূল কারণ তার চিন্তার বিপ্লব। তিনি মুসলমানদের আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা ও আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী হতে শিখিয়েছেন। তার দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল “খুদি”- যা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন “আত্মসত্তা” বা “আত্মচেতনা” হিসেবে। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘‘আসরারে খুদি’’ বা ঞযব ঝবপৎবঃং ড়ভ ঃযব ঝবষভ-এ তিনি বলেন, “নিজেকে চিনে নাও, কারণ তোমার মধ্যে লুকিয়ে আছে সৃষ্টির রহস্য।” তার মতে, মানুষ কেবল তখনই মহান, যখন সে নিজের মধ্যে আল্লাহর নিদর্শনকে উপলব্ধি করতে পারে।

ইকবালের কবিতা ইসলামি আত্মসমালোচনা ও জাগরণের এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। তার “শিকওয়া” ও “জবাব-এ-শিকওয়া” মুসলিম উম্মাহর আত্মার আর্তনাদ ও জবাব। “শিকওয়া”-য় তিনি আল্লাহর কাছে যেন প্রশ্ন তোলেন আমরা তোমার দ্বীন প্রতিষ্ঠায় জীবন দিয়েছি, তবুও কেন আমরা অপমানিত? কেন মুসলিম জাতি পরাজিত ও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ? কিন্তু “জবাব-এ-শিকওয়া”-য় তিনি আল্লাহর উত্তর দেন, “তোমরা ঈমান হারিয়েছ, তোমরা আত্মবিশ্বাস হারিয়েছ, তোমাদের হৃদয়ে আর খুদি নেই, তাই আমার রহমত তোমাদের থেকে দূরে।” এই দুই কবিতা একসঙ্গে ইসলামি জাগরণের ভিত্তি রচনা করে, যেখানে অভিযোগের পর আসে আত্মসমালোচনা, আর আত্মসমালোচনার পর আসে পুনর্জাগরণের ডাক।

ইকবালের কবিতায় আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি শ্রদ্ধা ছিল অফুরন্ত। তার জীবনের প্রতিটি শিরায়-উপশিরায় প্রবাহিত ছিল আল্লাহপ্রেমের উষ্ণতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকারের কবিতা হলো আল্লাহর স্মরণ, আর প্রকৃত শিল্পী সেই, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়। তার একটি কবিতায় তিনি বলেছিলেন, “আমার কবিতা যদি আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে, তবে আমি কবি নই, বরং শব্দের ব্যবসায়ী।” রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে তিনি এমনভাবে লিখেছেন, যা পাঠ করলে হৃদয় ভরে ওঠে ভালোবাসায়। তিনি বলেছিলেন, “আমি যদি কিছু হয়ে থাকি, তবে তা তার উম্মত হওয়ার কারণে; তিনি না থাকলে আমি কিছুই নই।”

ইকবালের চিন্তায় জিহাদ ছিল আত্মশুদ্ধির ও আত্মবিপ্লবের প্রতীক। তিনি বলেছিলেন, “তরবারির জিহাদ নয়, আত্মার জিহাদই প্রকৃত জিহাদ।” তার জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ছিল মনের পরিশুদ্ধি, চিন্তার স্বাধীনতা ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। তিনি তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “তোমরা ঈগল, তোমাদের উড়ান আকাশের সীমা পেরিয়ে যাক; কারণ তোমাদের গন্তব্য আকাশ নয়, বরং আরও ওপরে।” এই আহ্বান আজও প্রতিটি মুসলিম তরুণের হৃদয়ে আলোকছটা জ্বালিয়ে দেয়।

তার রচনাসম্ভার যেমন গভীর তত্ত্বে পূর্ণ, তেমনি সাহিত্যরূপেও অনন্য। বাল-এ-জিবরিল, জরব-এ-কালীম, রুমুজ-এ-বেখুদি, পায়াম-এ-মাশরেক, আরমুগান-এ-হিজাজ- প্রতিটি গ্রন্থই এক একটি বিপ্লবের দিশারি। তার কবিতায় যেমন প্রেম আছে, তেমনি প্রতিবাদও আছে। তিনি বলেছিলেন, “যে প্রেম আল্লাহর জন্য নয়, তা কেবল দেহের মায়া; আর যে প্রেম আল্লাহর পথে, তা জিহাদের অগ্নিশিখা।” তার কলমে প্রেম, বোধ ও সংগ্রাম একাকার হয়ে গিয়েছিল।

১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল লাহোরে এই মহাপুরুষ ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর সংবাদে সমগ্র উপমহাদেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তার চিন্তা, কবিতা ও দর্শন আজও জীবন্ত। লাহোরের বাদশাহী মসজিদের পাশে তার সমাধি যেন এক অনন্ত নীরবতার কাব্য। সেখানে আজও হাজারো মানুষ আসে তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের হারানো আত্মমর্যাদা খুঁজে নিতে। তার সমাধিস্থলে বাতাসে ভেসে আসে যেন সেই অমর আহ্বান- “উঠে দাঁড়াও, নিজের খুদি জাগাও, কারণ আল্লাহ সেই জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যারা নিজের পরিবর্তন ঘটায় না।”

আল্লামা ইকবাল ছিলেন এক অনন্ত আলো, এক আত্মিক বিপ্লবের প্রতীক। তার জীবন আমাদের শেখায়, ইসলাম কোনো নির্জীব দর্শন নয়; এটি জীবনের শক্তি, মুক্তির আহ্বান। তিনি প্রমাণ করেছেন, কবিতা কেবল সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়, বরং সত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। তার কণ্ঠে আমরা শুনি এক আহ্বান- “দাসত্ব নয়, আত্মমর্যাদা; ভোগ নয়, ত্যাগ; সন্দেহ নয়, ঈমান।” আজকের ভাঙা মুসলিম সমাজের জন্য ইকবাল এক নবজাগরণের আলোকবর্তিকা। তার খুদি দর্শন আজও আমাদের শেখায়, নিজেকে চিনো, নিজের মধ্যে আল্লাহর নিদর্শন খুঁজে পাও, আর নিজের শক্তিকে কাজে লাগাও মানবতার কল্যাণে।

সময়ের ঘূর্ণাবর্তে সভ্যতা যেমন বদলায়, প্রজন্ম যেমন আসে আর যায়, কিন্তু ইকবালের চিন্তা তেমনই চিরসবুজ। কারণ তিনি মহাকালের কবি, যার কণ্ঠে আজও ধ্বনিত হয় আত্মমুক্তির গান। যত দিন মুসলিম জাতি তার পরিচয় খুঁজে ফিরবে, তত দিন আল্লামা ইকবাল থাকবেন প্রেরণার উৎস হয়ে। তিনি যেন বলেই যাচ্ছেন- “তুমি নিজেকে ছোট মনে করো না, তোমার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক মহাবিশ্ব।” এই বাণীই আজ আমাদের মুক্তির পথ, এই বাণীই ইকবালের অমর উত্তরাধিকার।

লেখক: কলামিস্ট, এমফিল গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।

sultanmh17@gmail.com 

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর