ভূমিকম্প একদিকে প্রকৃতির পার্থিব প্রক্রিয়ার ফল হলেও, অন্যদিকে তা আধ্যাত্মিক ও ঈমানি দৃষ্টিকোণ থেকে গভীর শিক্ষা বহন করে। এই পৃথিবীতে যা ঘটে, তার পেছনে শুধুমাত্র ভূতাত্ত্বিক কারণ নয়, বরং মানুষের গুনাহ, অনাচার, সীমালঙ্ঘন এবং সামাজিক অবাধ্যতার সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে কোনো সম্প্রদায়কে শাস্তি দিতে পারেন, কোনো সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করতে পারেন, এবং মুমিনদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে এ ধরনের ঘটনা প্রেরণ করতে পারেন। প্রতিটি বিপদ ও দুর্যোগ মানুষকে তাদের কর্মের ফলাফলের দিকে মনোযোগী করার এবং তওবা, তাকওয়া ও সদকার মাধ্যমে নিজেদের ঠিক পথে ফেরানোর সুযোগ হিসেবে প্রেরিত হয়। কুরআনুল করিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, পৃথিবী ও সমুদ্র নাশের কারণ হলো মানুষের নিজের কর্ম, যাতে তারা তাদের কর্মের ফল ভোগ করে এবং ফেরে। (সুরা রূম: ৪১) অন্য আয়াতে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি (আল্লাহ) ক্ষমা করে দেন। (সুরা শুরা: ৩০)
দুর্যোগের কারণ:
মানুষ প্রায়শই দুর্যোগের কারণ খুঁজে বের করার সময় শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণকে দায়ী করে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি ঘটনা আল্লাহর ইচ্ছা ও কুদরতের অধীনে সংঘটিত হয়। প্রতিটি বিপর্যয় আমাদের জন্য শিক্ষা, হিকমত এবং আত্মপরীক্ষার এক মাধ্যম। সুতরাং ভূমিকম্প কেবল একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়; এটি মানুষকে সচেতন করার, আত্মসমীক্ষা করার এবং তওবার পথে ফিরে আসার এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
হাদিসের আলোকে ভূমিকম্পের কারণ:
হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, যেখানে নবি করিম (সা.) বলেন, যখন নিম্নলিখিত অপরাধগুলো সমাজে বিরাজ করতে শুরু করবে, তখন সেই যুগে ভূমিকম্প, জমিন ধ্বস, চেহারা বিকৃতি, আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ এবং অন্যান্য ভয়াবহ আজাবের ইনতেজার কর। আর বিপর্যয়গুলো এমন ধারাবাহিকভাবে ঘটবে, যেন একটি পুরাণ হারের সূতা ছিড়ে গেলে একটার পর একটা দানা পড়তে থাকে।
অপরাধগুলো হলো- গনীমতের সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদ বলে গণ্য করা। যাকাতকে জরিমানা বলা। দ্বীনী উদ্দেশ ছাড়া ইলম অর্জন করা। পুরুষরা স্ত্রীদের আনুগত্য করা। মায়ের অবাধ্য হওয়া। বন্ধুদের নিকটবর্তী করে আর পিতাকে দূর করা। মসজিদে শোরগোল করা। পাপাচারীরা গোত্রের নেতা হয়ে যাওয়া। নিকৃষ্ট লোকেরা সমাজের নেতা হওয়া। অনিষ্টের আশংকায় কাউকে সম্মান করা। গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের বিস্তার ঘটা। মদ্যপান ছড়িয়ে পড়া। উম্মতের শেষ যুগের লোকেরা প্রথম যুগের লোকদেরকে অভিসম্পাত করা। (সুনানে তিরমিজি: ২২১৪)
বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এসব অপরাধগুলো আজকের সমাজে বিদ্যমান। প্রতারণা, অসৎ কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক ব্যর্থতা, আধুনিক শিক্ষার দম্ভ, মসজিদের পবিত্রতা বিনষ্ট, পরিবারে অভিভাবকের প্রতি অবজ্ঞা, নেতৃত্বের অযোগ্যতা, গান-সিনেমা ও মদ্যপানের বিস্তার- সবই ঘটছে এই সমাজে।
ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, মানুষের গুনাহের কারণে পৃথিবীতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তার মধ্যে ভূমিকম্পও অন্তর্ভুক্ত। তিনি আরও বলেন, একবার আনস বিন মালিক (রাযি.) ও একজন লোক হযরত আয়েশা (রাযি.) নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: হে ঈমানদার মা, ভূমিকম্প সম্পর্কে আমাদের বলুন। আয়েশা (রাযি.) বললেন, যখন মানুষ প্রকাশ্যে অনাচার করে- যেমন অবৈধ সম্পর্ক, মদ্যপান, এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানো, তখন আল্লাহ পৃথিবীকে আদেশ দেন, তোমরা তাদের উপর কেঁপে উঠো। যদি তারা তওবা করে এবং অনাচার ত্যাগ করে, তাহলে আল্লাহ মাফ করে দেন; না হলে শাস্তি প্রদান করেন। এটি মুমিনদের জন্য শিক্ষা এবং কাফিরদের জন্য দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি। (মুসতাদরাক হাকেম: ৮৬২২)
ভূমিকম্প কিয়ামতের আলামত:
রাসুল (সা.) বলেছেন, কিয়ামত সে পর্যন্ত হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং খুনখারাবি বাড়বে, তোমাদের সম্পদ এতো বাড়বে যে, উপচে পড়বে। (সহিহ বুখারি-৯৭৯)
ভূমিকম্পের ব্যপারে কুসংস্কার: ভূমিকম্পকে ঘিরে মানুষের মাঝে বিভিন্ন অদ্ভুত ধারণা প্রচলিত আছে। কেউ বলে, অতিপ্রাকৃতিক শক্তিসম্পন্ন বিশাল দানবরা, যারা নাকি পৃথিবীর ভেতরে বাস করে, তারাই ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। হিন্দুদের একটি বিশ্বাস হলো পৃথিবী নাকি একটি গরুর শিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে; গরুটি যখন শিং বদলায়, তখন ভূমিকম্প হয়। কিছু বানোওয়াট রেওয়াতেও এই ধরণের কথাবার্তা রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলে পৃথিবী একটি বিশাল কাছিমের পিঠের ওপর রাখা, সে নড়াচড়া করলে ভূমিকম্প হয়। এগুলো সম্পূর্ণ-ই কুসংস্কার।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প:
বিজ্ঞানীদের মধ্যেও ভূমিকম্প সম্পর্কে মতভিন্নতা রয়েছে। কারও মতে, পৃথিবীর ভেতরের গরম বায়ু বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করলে ভূমিকম্প হয়। আবার কেউ বলেন, পৃথিবী ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হচ্ছে, আর এই ঠাণ্ডা হওয়ার প্রক্রিয়ায় এর বাইরের স্তরে ফাটল সৃষ্টি হয়, ফলে ভূমিকম্প দেখা দেয়। কিছু বিজ্ঞানীর দাবি, পৃথিবীর অভ্যন্তরে ভয়াবহ উত্তাপের অগ্নিগহ্বর আছে, যার প্রভাবে পৃথিবীর শরীর বেলুনের মতো স্ফীত হয়; আর সে কারণেও ভূমিকম্প হতে পারে।
যদিও বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হলো প্লেট টেকটোনিক্স তত্ত্ব। বহু ভূতত্ত্ববিদও মনে করেন, পৃথিবীর স্তরগুলো মাটি, পাথর ও শিলাপুঞ্জের বিশাল প্লেট দ্বারা গঠিত। যখন এই প্লেটসমূহ ভূ-চাপের কারণে ভেঙে যায় বা স্থানচ্যুত হয়, তখন ভূকম্পীয় তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। তরঙ্গগুলো দেখা না গেলেও এর কারণে ভূমির ওপরের সবকিছু কাঁপতে থাকে।
কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইসলামের ভাষ্যে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ভূমিকম্পের মূল কারণ হলো মানুষের পাপাচার, অবাধ্যতা ও আল্লাহর বিধান থেকে বিচ্যুতি। এর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন এবং সতর্কবার্তা দেন। অতএব, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা বাহ্যিক কারণ নির্দেশ করলেও, ইসলামের দৃষ্টিতে ভূমিকম্পের প্রকৃত হিকমত হলো- বান্দাদের আল¬াহর দিকে ফিরে আসার একটি শক্তিশালী স্মরণবাণী।
ভূমিকম্পে নিহত ব্যক্তি:
যে ব্যক্তি ঈমানের হালতে ভূমিকম্প বা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় মারা যায়, সে শহিদে হুকমি হিসাবে গণ্য হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, শহীদ পাঁচ প্রকার। যে শত্রুর আঘাতে নিহত হয় বা পেটের ব্যথায় মারা যায়, অথবা জলে ডুবে মারা যায়, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে মারা যায় তারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়। (২৮২৯)
পুনশ্চ: ভূমিকম্পের কাঁপন শুধু মাটিকে নড়ায় না, এটি মানুষের হৃদয়, বিবেক ও অহংকারকে গভীরভাবে ঝাঁকিয়ে দেয়। পৃথিবীর বুকের এই সামান্য কাঁপনে সভ্যতার সমস্ত আয়োজন মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। যেন খোদায়ী বার্তা অনুরণীত হয়ে উঠে ধ্বনিত হতে থাকে দেখো! তোমাদের উন্নতি, প্রযুক্তি, শক্তি সবকিছু সত্ত্বেও তোমরা কত দুর্বল। তাই তোমাদের ফিরতে হবে আমার দিকেই।
ইসলাম আমাদের শেখায়, এ ধরনের বিপর্যয় অকারণে নয়। এগুলো সতর্কবার্তা, মানুষের ভুল ও অবহেলার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে এক শক্তিশালী বার্তা। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যখন কোনো জাতি আল্লাহকে ভুলে যায়, গুনাহে ডুবে থাকে, তখন নানা দুর্যোগ তাদের অন্তরে ভয়ের ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়; যাতে তারা ফিরে আসে, অনুতাপ করে, সংশোধন হয়।
একজন ঈমানদার সেই সতর্কতাকে অস্বীকার করে না, হতাশও হয় না। বরং ভূমিকম্পের প্রতিটি কম্পন তার অন্তরে ঈমানের আলোকে উজ্জ্বল করে তোলে। সে মনে করে, আজ যদি ক্ষণিকের কম্পনে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়, তবে কেয়ামতের মহান ভূমিকম্পে মানুষের অবস্থা কী হবে?
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।
বিকেপি/এমবি

