Logo

ধর্ম

কওমি মাদরাসা দ্বীন রক্ষার দুর্গ

Icon

মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১১:২১

কওমি মাদরাসা দ্বীন রক্ষার দুর্গ

জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান-সাধনা মানুষের আদি প্রবৃত্তি। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা এবং অজয়কে জয় করা মানুষের সহজাত গুণ। জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান অর্জন করতে হলে শিক্ষা অপরিহার্য। তাই মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে জ্ঞান-সাধনা ও শিক্ষার প্রসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাস্তব কারণেই মহানবী (সা.) শিক্ষা অর্জন ও জ্ঞানর্চার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ জ্ঞানের ভাণ্ডার আল কুরআনের ধারক-বাহক। অজ্ঞতার এক চরম পর্যায়ে, অশান্তির এক অগ্নিঝরা দিনে, জালিমের দোর্দণ্ড প্রতাপে মাজলুম মানবতার মুক্তি যখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠেছিলো, ঠিক সে সংকটের সন্ধিক্ষণে শিক্ষার আলোকিত মশাল নিয়ে এসেছিলেন মহানবী (সা.)। তার এ জ্ঞানের মশাল জ্বলে ওঠেছিলো শত দীপশিখায়, ছড়িয়ে পড়েছিলো দিগদিগন্তে। তার আবির্ভাবে এবং কুরআনের চির নির্ভুল সত্যবাণী অবতীর্ণ হবার ফলে অজ্ঞতার গাড় অন্ধকার কেটে গেলো। বিশ্বমানবতা লাভ করলো জ্ঞান বিজ্ঞানের এক পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন। তার জীবন শিক্ষা প্রসারে তিনি এতই তৎপর ছিলেন যে, অত্যল্পকালের মধ্যেই তা চারদিক ছড়িয়ে পড়লো। সমগ্র বিশ্ব আজও বিশ্বনবীর জ্ঞানবলয়ের প্রভাবে প্রভাবান্বিত।

রাসুল (সা.)- এর জ্ঞানের উৎস:

প্রিয়নবী (সা.) আশৈশব ছিলেন উম্মী তথা তিনি ছিলেন দয়াময় আল্লাহর তত্ত্বাবধানে তৈরী একজন আদর্শ শিক্ষক। মহান রাব্বুল আলামিন তাকে নিজের দেয়া জ্ঞানে ভূষিত করেন। মহান আল্লাহই ছিলেন তার শিক্ষক। মানবীয় বিবেচনায় তিনি উম্মী, অথচ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। অসীম ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তাকে শিক্ষা দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’  হুজুর (সা.)- এর সকল জ্ঞানের উৎস হলেন মহান রাব্বুল আলামিন এবং তার প্রদত্ত কিতাব। সেজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমাদের সঙ্গী মুহাম্মদ কখনোই ভুল করেন না।’ (সুরা নাজম: ০২)। ওহী ও মেরাজে গমনের ফলে মহানবী (সা.) যে প্রত্যক্ষ জ্ঞানার্জন করেছেন, সে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি ‘আল্লাহ, মানুষ ও প্রকৃতির’ পারস্পরিক সম্পর্ক ও নীতি শিক্ষাদান করেছেন গোটা মানব জগতকে।

শিক্ষা ও জ্ঞান প্রদানে রাসুল (সা.)- এর লক্ষ্য:

ইসলামের দৃষ্টিতে চিরন্তন ও শাশ্বত নৈতিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে সত্য-মিথ্যা, ভালোমন্দ নির্ধারণের ক্ষমতা অর্জন, পরিবেশের সঙ্গে মোকাবিলার জন্যে বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার নামই শিক্ষা। নবী রাসুলের কার্যাবলী বর্ণনা করার প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তাদের কাজ হলো, মানুষকে কিতাব, হিকমাহ এবং পরিশুদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দান করা।’ এ জন্যই ইসলামের সূচনাপর্বে মহানবী (সা.) তার সঙ্গীদেরকে ইসলামের যাবতীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্যে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থার প্রয়োজনে সাফা মারওয়ার পাদদেশে অবস্থিত ‘দারুল আরকামকে’ বেছে নেন, যা ছিলো মুসলিম উম্মাহর প্রথম শিক্ষালয়।

শিক্ষা অর্জনে মহানবী (সা.)- এর উৎসাহ প্রদান:

প্রিয়নবী জ্ঞান শিক্ষার প্রতি খুব উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক নর-নারীর ওপর জ্ঞানার্জন করা ফরজ।’ এ হাদিস হতে জানা যায়, জ্ঞান অর্জন অন্যান্য ইবাদতের মতই ফরজ। শিক্ষা গ্রহণের জন্য রাসুল (সা.) কোনো বয়স না সময় বা কালকে সীমাবদ্ধ করেন নি। কেননা, জ্ঞান অসীম। জীবনব্যাপী মানুষ জ্ঞানচর্চায় আত্মনিয়োগ করবে। এটাই মহানবী (সা.)- এর শিক্ষা।

শিক্ষা বিস্তারে রাসুল (সা.)

শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) দুনিয়ার বুকে এক মহান আদর্শ রেখে গেছেন। আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতের সময় মদিনার কিছুসংখ্যক মানুষ ইসলাম কবুল করলে প্রিয়নবী তাদের শিক্ষকরূপে মুসআব বিন উমায়ের (রা.) কে প্রেরণ করেন। মুসআব মদিনায় পৌঁছার কয়েকদিন পর মহানবী (সা.) জুমার নামাজ ও তৎপূর্বে খুৎবা দানের জন্য নির্দেশ পাঠান। এই খুৎবার উদ্দেশ ছিলো, আপামর জনগণকে শিক্ষাদান করা। মদীনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.) মসজিদে নববী নির্মাণ করেন, যার একাংশ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। শিক্ষা কেন্দ্রটি ‘সুফফা’ নামে পরিচিত। এটিই ইসলামের প্রথম জামেয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়। নবী কারিম (সা.) ছিলেন এর প্রধান শিক্ষক। যুদ্ধ, রাজনৈতি, সমাজ সংস্কার এবং নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি একটা উল্লেখযোগ্য সময় শিক্ষকতায় ব্যয় করতেন। কাল পরিক্রমায় সেই নূরের ধারক ও বাহক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কওমি মাদরাসা। এখানে রাত-দিন তাওহীদ ও রিসালাতের সুমহান বাণী পর্যালোচনা হয়। সকাল-সন্ধ্যা আখেরাতের পাঠদান করা হয়। এক এক করে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় চারিত্রিক নৈতিকতার অর্জনীয় ও বর্জনীয় গুণগুলোর।

ইসলামি শিক্ষার সিলেবাস

আমি এখানে ইসলামি শিক্ষার সিলেবাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো না। কেবল তার দাবী ও লক্ষ্য কী? তা নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। ইসলামি শিক্ষার সিলেবাসের একমাত্র দাবী হলো, দীনের পূর্ণ অনুসরণ যুগ সন্ধিক্ষণে সৃষ্ট সকল বাতিলের মস্তক চূর্ণ করে হকের পতাকা সমুন্নত রাখতে পারে এমন আলেম তৈরি করা। লক্ষ্য হলো, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে ইসলামের নির্ভুল জ্ঞান প্রদান করা। সম্প্রতি আমরা দেখতে পারি কওমি ছাড়া অন্যত্র যেকোনো সিলেবাস আমাদেরকে যুগ সচেতন আলেম উপহার দিতে পেরেছি কী? দেখা যাবে এর সংখ্যা শূন্যের কোটায়। বিষয়টি আরও স্পষ্টরূপে বুঝতে হলে আমাদের খানিকটা গভীরে যেতে হবে। কওমি আমাদের কী কী উপহার দিচ্ছে আর কীভাবে দিচ্ছে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা এখানে কাম্য। আমি প্রাথমিকভাবে তিনভাবে বিভক্ত করছি। বিশুদ্ধরূপে কোরআন শিক্ষা দেয়া। কিতাব বা হেকমত শিক্ষা দেয়া। তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি। পর্যায়ক্রমে এ নিয়ে আলোচনায় প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।

কোরআন শিক্ষা

তেলাওয়াতের সম্পর্ক শব্দের সঙ্গে আর আহকামের সম্পর্ক অর্থের সঙ্গে। সুতরাং তেলাওয়াত ও মর্মানুধাবন উভয়টি পৃথক পৃথক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। একটি অন্যটির বিচ্ছিন্ন ভাবার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই এখানে। কারণ ফকিহগণ কোরআনের সংজ্ঞা দিয়েছেন শব্দ ও অর্থ উভয়টির সমষ্টিকে নিয়ে। অতএব কোরআনের অর্থ অনুধাবনের জন্য যেমন গুরুত্বারোপ দিতে হবে, তদ্রƒপ শব্দ অনুধাবনের জন্যও গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অন্য যেকোনো সিলেবাসে এর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ফলে দেখা যায় একজন ছাত্র টাইটেল উত্তীর্ণ হওয়ার পরও যথাযথ কোরআন পড়তে পারে না। অথচ রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘অনেক ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করে, তথাপি কোরআন তাদের অভিশাপ করে।’ সমাজে যিনি দীনের ঝাণ্ডারূপে পরিচিত তিনিই যদি উক্ত হাদিসের ধমকের শিকার হয়ে যান, তাহলে এরচেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?

কিতাব বা হেকমত শিক্ষা

মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতি জীবন চলার গতি নির্ধারণের জন্য সংবিধানরূপে যা প্রেরণ করেছেন, তাকে কিতাব বলে। আর এ মহামূল্যবান সম্পদের বাহক নবী-রাসুলগণ এর বাস্তব প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে যেই ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, তাকে হিকমত বা সুন্নাহ বলে। উম্মতে মুহাম্মদির ওপর কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে আরবিতে, হাদিস পঠিত হয়েছে আরবিতে, মৌলিক ফেকাহ গ্রন্থিগুলিও আরবিতে রচিত। একজন আদর্শ শিক্ষকের কর্তব্য হলো, কোরআন, হাদিস, ফেকাহ তার ভাষায় যথার্থরূপে শিখে ছাত্রদের অনুরূপ ভাষা ও ভঙ্গিতে শিখিয়ে দেয়া। অন্যথায় তার মর্মার্থ আবেদন একজন তালেবে ইলমের মাঝে কখনই তৈরি হবে না। কিন্তু অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরবি থেকে বাংলার প্রতি প্রাধান্য বেশী। অথচ কওমিতে আরবি বাংলা উভয়টি সমানভবে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, বরং যেখানে যতটুকু প্রয়োজন তার বাস্তব প্রতিফলন যথাযথ কওমিতেই পরিলক্ষিত হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ্। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা অবশ্যই আমাদের জানা প্রয়োজন, কিন্তু ধর্মীয় বিষয়ক গ্রন্থগুলো অবশ্যই আরবিতে পড়ানো উচিৎ।

তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি

সংশোধনের নিমিত্তে বিশুদ্ধ শিক্ষাই কার্যকরী ভূমিকা নয়, বরং চারিত্রিক প্রশিক্ষণ অতিপ্রয়োজন। কারণ শিক্ষার কাজ হলো, প্রকৃতপক্ষে সরল ও নির্ভুল পথের দিশা। তবে কেবল পথ জানা থাকলেই গন্তব্যে পোঁছা যাবে, তা কিন্তু নয়। এর জন্য বিভিন্ন পাথেয় অর্জন করতে হয়। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব এটাও যে, তিনি ছাত্রকে আক্ষরিক জ্ঞানের পাশাপাশি পারলৌকিক জ্ঞানেরও শিক্ষা দিবেন, যেন সে চলার পথে পা পিছলে না যায়। ফলে একজন ছাত্র সর্বোচ্চ শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তার পোশাক, স্বভাব, চরিত্র ও চুল দাড়িতে সুন্নতের প্রভাব পড়ে না। যেখানে তার শিক্ষকের মাঝে পাশ্চাত্যরীতি বিদ্যমান, সেখানে ছাত্রের মাঝে কেমন প্রভাব পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ কওমিতে সুন্নতের পূর্ণ অনুসরণ সবসময় ও সর্বত্র বিরাজমান।

ইসলাম দুই ধরনের শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রথমত প্রকাশ্য শত্রু ইহুদি খ্রিষ্টান হিন্দু ইত্যাকার অমুসলিম শ্রেণী। দ্বিতীয়ত ইসলামের ছদ্মনাম গুপ্ত শত্রু যেমন খারেজি, রাফেজি, কাদিয়ানী, মওদুদী, শিয়া, মুতাজেলা ইত্যাদি। প্রকাশ্য শত্রুর আক্রমণ সচেতন মুসলমান মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। কিন্তু গুপ্ত শত্রুর সু²দর্শীর আক্রোশ একমাত্র সচেতন দীনি শিক্ষকই বুঝতে ও অনুধাবন করতে পারেন। তাই আক্রমণ বা আক্রোশ যেপথে আসুক না কেন, একজন যুগসচেতন আলেম এর মোকাবিলা করবেন তার যোগ্যতা দিয়ে। আর এ প্রকৃতিগত আক্রমণের কয়েকটি ধারা রয়েছে। তা হচ্ছে, সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি সাধন থেকে ইসলামকে রক্ষা করা। মিথ্যাচারীদের কুটিলতা থেকে ইসলামকে জিয়ে রাখা। অজ্ঞদের অপব্যাখ্যা থেকে ইসলামকে টিকিয়ে রাখা। ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি

ইসলাম কেয়ামত পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এর মাঝে কোনপ্রকারের সীমালঙ্ঘন করাকে ইসলাম কখনও সহ্য করে না। এরপরেও এমনকিছু সীমালঙ্ঘনকারী গজিয়ে উঠেছে, যারা মস্তিষ্ক প্রসূত চিন্তা ধারার মাধ্যমে গোটা ইসলামকে বিকৃতি করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মানসিকতা পোষণ করছে প্রতিনিয়ত। কাদিয়ানী, মওদুদী শিয়া এ ধারার ভ্রান্তি দল। সুতরাং এ থেকে তারাই রেহাই পাবে, যারা প্রকৃত দীনের ধারাকে আঁকড়ে ধরেছে।

মিথ্যাচারীদের কুটিলতা

ইসলামের সূচনাকাল থেকে যুগে যুগে ইসলামের অপব্যাখ্যাকারীর আবির্ভাব ঘটেছে। যারা ইসলাম শব্দটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গোটা ইসলামকে স্বীয় মস্তিষ্কের আলোকে ব্যাখ্যা করেছে। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, তারা ইসলামী না হয়ে ইসলামটাই তাদের হয়ে গেছে। খারেজী, মুতাজেলি, মওদুদি রেজভি এ ধারারই ভ্রান্ত দল।

অর্বাচীনদের অপব্যাখ্যা

আমাদের সমাজের ভোগবাদের পুজারী কিছু জ্ঞানপাপী রয়েছেন, যাদের মন-মস্কিষ্ক চিন্তা-চেতনা সর্বক্ষেত্র পাশ্চাত্যের চিন্তা ধারায় প্রভাবান্বিত। কোনো জিনিসকে তারা বৈধ অবৈধ মানদণ্ডে বিচার করতে অনিচ্ছুক। যদিও মুসলিম সমাজের কারণে তা সবাই প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু তারা অত্যন্ত চাতুরতার সঙ্গে শরয়ি দলীলকে বিকৃত করে অনেক হারামকে হালাল করার চেষ্টা করে। ব্যবসাকে হালালের ধোঁয়াশায় সুদকে হালাল করে। ইসলাম সৌন্দর্যকে পছন্দ করে বলে বেপর্দাকে বৈধ বলে। উদ্দেশ প্রণোদিতভাবে কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করে বাল্যবিবাহ বৈধ করে এমন অনেক কীর্তি কাণ্ড ঘটিয়ে থাকে তারা। এর প্রতিফল যে কেবলই ক্ষতি তার ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি।

‘ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ একটা অমানবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। কেননা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়, ঋণ তো অভাবীরা গ্রহণ করেন। আর যারা ঋণ দেন, তারা তো নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পর উদ্বৃত্ত অর্থটাই কেবল ঋণ হিসেবে বিনিয়োগ করেন। আপনার গ্রাম বা মহল্লার দরিদ্র চাষি, একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা একজন শ্রমজীবীর কথা চিন্তা করে দেখুন, সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করলে তার অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। মনে করি, রিহান নামক ব্যক্তির নিজস্ব আয়ে বছরে দশ মাস ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। শেষ দুই মাসে সে সুদে টাকা নিয়ে সংসারের আয় বাড়ানোর কাজে বিনিয়োগ করল। দ্বিতীয় বছর সব মিলিয়ে সে বারো মাস চলার মতো সামর্থ্য অর্জন করল। কিন্তু তা সত্ত্বেও পূর্ববর্তী বছরের ঋণ এবং সুদ পরিশোধের পর অবশিষ্ট অর্থে তার নয় মাস চলল। সুতরাং এ বছর তার তিন মাসের ব্যয় নির্বাহ করতে হবে নতুন করে ঋণ গ্রহণ করে। এবার হিসাব করে দেখুন, সুদে টাকা ধার নিয়ে এ নি¤œধ্যবিত্ত পরিবারটির পথে বসতে ক’বছর সময়ের প্রয়োজন হবে? এভাবেই সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার মারপ্যাঁচে পড়ে একটি পরিবার থেকে শুরু করে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে হতদরিদ্র ও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।

অর্থনীতি অনেক জটিল বিষয়। এ বিষয়ে বড় বড় পণ্ডিত যারা আছেন, তারা এর পক্ষে-বিপক্ষে জটিল জটিল সব যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করতে সক্ষম। এমনকি বড় বড় যুক্তি আর উদাহরণ টেনে তারা সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার মাহাত্ম্যও প্রমাণ করে ছাড়বেন, সন্দেহ নেই তাতে। আমার মতো স্বল্প বিদ্যা নিয়ে এসব বিতর্ক করাটাই এক প্রকার আহাম্মকি। তবে সবিনয়ে একটা কথা তো জিজ্ঞেস করতে পারি, আমাদের দেশের যেসব এনজিও সুদের বিনিময়ে অর্থ বিনিয়োগ করে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের জন্য নিরলস পরিশ্রম চালিয়ে আসছে- বিগত দশ-বিশ বছরের একটা পরিসংখ্যান নিয়ে দেখুন তো, এতে ফুলেফেঁপে উঠছে কারা? দরিদ্র ঋণগ্রহীতারা, নাকি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলো। নিঃসন্দেহ দ্বিতীয় পক্ষই। কিন্তু কেন? দেখুন একটু চিন্তা করে।

সমাজের এ সকল ফেৎনাকে চিহ্নিত করে মূলোৎপাটন করা একজন সচেতন আলেমের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের পূর্বশর্ত হলো, ইসলামি আকিদা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন। আর তা কেবল কওমি মাদরাসায় পূর্ণাঙ্গরূপে যুগযুগ ধরে দিয়ে আসছে। একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কীরূপ হবে, তা যথাযথভাবে তালিম দেয়া হচ্ছে একমাত্র কওমিতে। নিরবচ্ছিন্ন উৎকৃষ্ট পাঠদানের সঙ্গে সঙ্গে উস্তাদের সংশ্রব অত্যাবশ্যকীয়। দীনি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছাত্র-উস্তাদের সম্পর্ক মসজিদে নববী আসহাবে সুফফার যথার্থরূপ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আর সেভাবেই গড়ে তোলা হচ্ছে একজন কওমি তালেবে ইলমকে।

একজন কওমি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে নিগড় সম্পর্ক কেমন এবং একজন শিক্ষকের মর্যাদার মাপকাঠি কতটুকু? তা বলতে গিয়ে বলতে হয়, শিক্ষাদান এবং শিক্ষা গ্রহণ, এরূপ দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুন্দর সম্পর্ক। দাতা গ্রহীতার সম্পর্কের চেয়ে অনেক পবিত্র এ সম্পর্ক। শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী কেবলই জ্ঞান লাভ করে না, তার উপদেশ ও পরামর্শ থেকে পায় জীবন ও চরিত্র গঠনের মূল্যবান নির্দেশনা। শিক্ষকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ হতে চাইলে তার প্রতি শিক্ষার্থীকে হতে হবে শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত, থাকতে হবে তার উপর গভীর আস্থা। আর তখনই শিক্ষক শিক্ষার্থীকে সর্বোত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সক্ষম হবেন। এর ফলে সাধিত হবে শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য এবং প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হবে সুন্দর পরিবেশ। শিক্ষার্থীর দুর্বিনীত আচরণ শিক্ষককে নিদারুণ হতাশায় ভরে তোলে, বিনিময় শিক্ষার্থী কিছুই লাভ করে না। অবাধ্য ও দুর্বিনীত শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে শিখতে পারে না কিছুই, তার অর্জন কেবলই শূন্য।

শিক্ষক মহৎ সেবা দানে নিয়োজিত। তার এ সেবা অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, যেমনি যায় না মাতা-পিতার সেবা সন্তানের প্রতি। মাতা-পিতা সন্তান জন্ম ও প্রতিপালনের গুরু দায়িত্ব পালন করেন আর শিক্ষক তাকে শিক্ষিত করেন। তার হৃদয়-মনকে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেন, তাকে সমাজে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে সে সম্পর্ক তা সকল হীন স্বার্থ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক কিছু প্রত্যাশা করেন না। শিক্ষক শিক্ষার্থীর মাঝে দেখতে চান জ্ঞানের আলো, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ এবং পরিচ্ছন্ন ও সচেতন মন। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক আশা করেন, সদাচারণ ও সৎস্বভাব। শিক্ষার্থীকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে শিক্ষক আনন্দিত হন। বিপথগামী হতে দেখে ব্যথিত হন। শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষকের যে ব্যাকুলতা, তা না পাওয়ার হতাশা নয়, বরং হারিয়ে যাওয়ার বেদনা, শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত না হওয়া বেদনা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার বেদনা।

শিক্ষার্থীর মাঝে যুগ যুগ বেঁচে থাকেন শিক্ষক। শিক্ষকের জ্ঞান ও দর্শন, শিক্ষা ও জীবনবোধ তার অজান্তে শিক্ষার্থীর মাঝে প্রোথিত হয়। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে কোনো কোনো শিক্ষার্থী তার প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতিচারণ করে। এ প্রিয় শিক্ষকই তার জীবনকে নাড়া দিয়েছে বিরাট করে, প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে। সৎ এবং নিষ্ঠাবান শিক্ষকই কেবল শিক্ষার্থীকে শিক্ষিত করতে এবং জীবন ও চরিত্র গঠনে তাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। আর এমন শিক্ষকই জাতির কাম্য, সবার কাছে সম্মানীয়। যে শিক্ষক শিক্ষার্থীর সামনে কোনো আদর্শ ও মূল্যবোধ উপস্থাপন ও তা লালনে সক্ষম নন, তিনি কখনোই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না। নীতি ও নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষক কখনও শিক্ষার্থীর আদর্শ ও প্রিয় শিক্ষক হতে পারেন না। কেননা, তিনি শিক্ষার্থীকে যথাযথ শিক্ষিত ও চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন।

মাতা-পিতা তার সন্তানকে শাসন করেন। সেটা যেমন স্বাভাবিক তেমনি স্বাভাবিক ও কাম্য হলো, শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শাসন করা। শিক্ষার্থীকে আজকাল শাসন করা যায় না, এমন কথা প্রায়শই শুনা যায়। তা ঠিক নয়। শিক্ষার্থী যথার্থ ক্ষেত্রে, যথাসময়ে তার শিক্ষকের যথার্থ নির্দেশনা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলাবোধ প্রত্যাশা করে ও পছন্দ করে। যতই দুর্বিনীত হোক না কেন। শিক্ষকের যথার্থ যুক্তি ও ন্যায়বোধের কাছে সে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। পরিবেশ ও প্রতিরোধ তা ক্ষণিকের জন্য বিলম্বিত করে মাত্র। শিক্ষার্থীরা বয়সে তরুণ, স্বভাবে চাঞ্চল্য ও চিন্তায় বিপ্লবী। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় ক্ষেত্রবিশেষে নেতৃত্ব দিতে চায়, কিছু একটা করতে চায়, সবার কাছে তার কৃতিত্ব তুলে ধরতে চায়। যথাযথ পথ নির্দেশের অভাবে এরা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়, হয় বিপথগামী। এদের মধ্যে নেতৃত্ব গ্রহণের ও সমস্যা সমাধানের কিছু প্রতিভা হয়ত আছে। এ সত্য উপলব্ধি করে তাদের প্রতিভা ও কার্যস্পৃহাকে যথাযথ খাতে চালিত করে তাদের মধ্যে যথার্থ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেন। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’।

সবিশেষ কথা হলো, প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাঝে লুকিয়ে আছে প্রতিভা, সুপ্ত হয়ে আছে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ। তারই যথার্থ বিকাশ ঘটাতে হবে। তাকে উত্তম চরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞানানুশীলনে শিক্ষার্থীর আন্তরিক প্রচেষ্টা। কর্তব্য পালনে শিক্ষকের নিষ্ঠা ও সততা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ এবং মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণ শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের সুসমন্বিত বিকাশ। শিক্ষার্থীকে সৎ ও নিষ্ঠাবান হিসেবে যেমনি গড়ে তুলতে হবে, শিক্ষা সমাপনের সঙ্গে সঙ্গে তেমনি উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগও থাকতে হবে বিস্তৃত ও অবারিত। আর সেই আদর্শ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী গড়ে উঠে কওমি নামক ইলমি কাননে। সুতরাং ধোঁয়াশার আবরণে ঘেরা পর্দাকে ছিড়ে ফেলতে কওমি শিক্ষার বিকল্প নেই।

লেখক: ইমাম, শ্যামপুর কদমতলী রাজউক তাকওয়া জামে মসজিদ ঢাকা।
ahmadabdullah7860@gmail.com

বিকেপি/এমবি

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর