আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস
মানবমর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সামাজিক দায়িত্ব
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:১৮
বিশ্বের সকল দেশে প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এই দিবস কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি মানবজাতির প্রতি এক সার্বজনীন অঙ্গীকার। প্রতিটি মানুষ-জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, বয়স বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে-সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করার অধিকার রাখে। ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহপাক বলেন, “আমি মানবজাতিকে মর্যাদা দিয়েছি, তাদেরকে জ্ঞান এবং দায়িত্ব দিয়েছি।” (সূরা আল ইসরা: ৭০) অর্থাৎ, জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষ মর্যাদাশীল। ইসলামে নারী ও পুরুষ উভয়কে সমান অধিকার প্রদান করা হয়েছে। হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, “মানুষের প্রতি দয়া করা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে।” (সহীহ মুসলিম: ৪৪২২) অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও ন্যায়ের চর্চাই মানবাধিকারের মূল ভিত্তি।
ইসলামে শিশু, নারী, প্রবীণ, গরীব, অসুস্থ বা প্রতিবন্ধী- সবকেই সমান মর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ আছে। কোরআনে বলা হয়েছে,“নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের পছন্দ করেন।” (সূরা আন-নিসা: ১২৫) নারীর শিক্ষার অধিকার, সম্পত্তি অধিকার, নিরাপত্তা এবং সম্মানের অধিকার ইসলামে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত।
ইসলামে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, দারিদ্র্য ও শোষণ দূর করা এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা মানবাধিকারের অপরিহার্য অংশ। হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন “যে ব্যক্তি দারিদ্র্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সে আল্লাহর পথে দাঁড়িয়েছে।” (সহীহ বুখারি: ৬৫০৮)
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের মূল উদ্দেশ্য মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা। কোরআনে নির্দেশ রয়েছে,“নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়ের আদেশ দেন, কলহ ও বিবাদ কমাতে বলেন এবং অন্যায় থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন।” (সূরা হুজুরাত: ৯) অর্থাৎ ন্যায়বিচার, মানুষের মর্যাদা রক্ষা এবং অন্যের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখা ইসলামের মৌলিক আদর্শ।
মানবাধিকারের বাস্তবায়ন কেবল আইন বা নীতিতে সীমাবদ্ধ নয়; দৈনন্দিন জীবনেও এটি প্রয়োগ করতে হবে। ইসলামে শিশুদের প্রতি সদ্ব্যবহার, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহানুভূতি, নারীর সম্মান এবং সামাজিক সংহতি- এসব নৈতিক দায়িত্বের অংশ। জাকাত ও সদকা দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়।
ইসলামে সামাজিক দায়িত্ব মানবাধিকারের বাস্তবায়নের অপরিহার্য অংশ। প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হলো অন্যদের অধিকার রক্ষা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সমাজে সহমর্মিতা প্রসারিত করা।
১. দরিদ্র ও অসহায়দের সহায়তা : যারা তাদের সম্পদ দিয়ে দরিদ্রদের সাহায্য করে, তারা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য।” (সূরা বাকারা: ২৭৫) জাকাত ও সদকা সমাজে সমতা ও ন্যায় নিশ্চিত করে।
২. অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো : যে ব্যক্তি দারিদ্র্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সে আল্লাহর পথে দাঁড়িয়েছে।” (সহীহ বুখারি: ৬৫০৮)
৩. প্রতিবেশী ও কমিউনিটির প্রতি দায়িত্ব : একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের জন্য ভাই। তাকে কোনো কষ্ট দেওয়া ঠিক নয়।” (সহীহ মুসলিম: ২৫৬৪) প্রতিবেশী ও সমাজের সঙ্গে সদ্ব্যবহার ও সহযোগিতা মানবাধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
৪. শিশু, নারী ও প্রবীণদের অধিকার রক্ষা : আপনারা শিশুদের প্রতি সদ্ব্যবহার করুন এবং তাদের অধিকার রক্ষা করুন।” (সহীহ বুখারি: ৬৫০৭, সহীহ মুসলিম: ১৪৪২) এটি সামাজিক ন্যায় এবং মানবাধিকার রক্ষার মৌলিক দায়িত্ব।
৫. সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়ের আদেশ দেন এবং অন্যায় থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন।” (সূরা হুজুরাত: ৯)
বৈষম্য ও শোষণ রোধ করে সমাজে সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব।
৬. শিক্ষা ও সচেতনতার দায়িত্ব : জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও মহিলার জন্য ফরজ।” (সহীহ বুখারি: ৭৭) শিক্ষা মানুষকে সচেতন ও দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।
৭. পরিবেশ ও সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব : যে ব্যক্তি পৃথিবীতে ক্ষতি ও অপব্যবহার কমায়, সে আল্লাহর নিকট প্রিয়।” (সহীহ তিরমিজি: ১৩৪৫) পরিবেশ ও সম্প্রদায়ের কল্যাণ রক্ষা ইসলামি সামাজিক দায়িত্বের অংশ।
পরিশেষে, ইসলামে মানবাধিকার মানে কেবল আইনগত অধিকার নয়; এটি নৈতিক দায়িত্ব, সামাজিক সচেতনতা এবং সহমর্মিতা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস আমাদের স্মরণ করায় যে, মানবাধিকার রক্ষা প্রতিটি মুসলিমের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব। অতএব, ১০ ডিসেম্বর কেবল একটি তারিখ নয়; এটি মানবতার প্রতি দায়বদ্ধ, ন্যায়ের পথে এবং ইসলামের আদর্শের প্রতি সচেতন হওয়ার প্রতীক। ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করে আমরা সত্যিকারের মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে মর্যাদা, ন্যায়, সমতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
লেখক : কলাম লেখক ও ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধকার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

