ফজরের আধ্যাত্মিক যাত্রা ও স্মৃতিমধুর ভোর
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:০৬
সময় মানুষকে বহুদূরে নিয়ে যায়। বদলে যায় শহর, বদলে যায় ঠিকানা, বদলে যায় জীবনের গতিপথও। কিন্তু কিছু অনুভূতি, কিছু স্মৃতি আর কিছু জায়গা থাকে- যেগুলো সময়ের স্রোতে ভেসে যায় না। ফেনী শহর আমার জীবনে তেমনই একটি নাম। এখানে আমার জন্ম নয়, দীর্ঘকালীন বসবাসও নয়; তবুও এই শহরের ভোর, এর মসজিদ, রাস্তাঘাট আর মানুষের সঙ্গে আমার এক ধরনের নীরব আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বহু বছর আগে। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর আবার ফেনীর এক ভোরে দাঁড়িয়ে সেই সম্পর্ককে নতুন করে অনুভব করলাম- ফজরের আজানের সুরে, নীরব রাস্তায় হাঁটায় আর স্মৃতির গভীরতায়।
ভোর তখনও পুরোপুরি আলোয় ভাসেনি। চারপাশে ছিল প্রশান্ত এক নীরবতা। ঘুমের নরম বালিশে মাথা রেখে মন যেন অজান্তেই শান্তির খোঁজে ডুবে ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে চারদিক থেকে ভেসে এলো ফজরের আজানের মধুর সুর। সেই ধ্বনি শুধু ঘুম ভাঙায়নি, ভেতরের মানুষটাকেও জাগিয়ে তুলেছিল- এক নতুন দিনের আহ্বানে।
আমি তখন বোনের বাসায় অবস্থান করছিলাম। দীর্ঘ ১৪ বছর পর এই শহরে রাত কাটানো, ভোর দেখা- সবকিছুতেই ছিল আলাদা এক আবেশ। আজানের ধ্বনি কানে যেতেই মনে দৃঢ় সংকল্প জন্ম নিল- আজ ফজরের নামাজ ঠিক সময়েই আদায় করব। সময় তখন ভোর ৫টা ১০ মিনিট। পূর্ব দিগন্তে সূর্যের আলো ধীরে ধীরে অন্ধকার সরিয়ে নিচ্ছে, যেন আল্লাহ মানুষের অন্তর থেকেও ধীরে ধীরে ক্লান্তি ও অস্থিরতা দূর করে দেন।
আজান শেষ হতেই দুই রাকাত সুন্নাত নামাজ আদায় করলাম। সিজদায় নত হওয়ার সেই মুহূর্তে মনে হলো, জীবনের বহু বছরের ব্যস্ততা, দৌড়ঝাঁপ আর চাপ যেন হালকা হয়ে এসেছে। ফজরের নামাজ কেবল একটি ফরজ ইবাদত নয়; এটি আত্মার বিশ্রাম, নিজের সঙ্গে নিজের নীরব কথোপকথনের সময়।
এরপর রওয়ানা হলাম ফেনীর ঐতিহ্যবাহী জহিরিয়া মসজিদের দিকে। এই মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফেনী দারুল উলূম মাদরাসার মুহতামিম মুফতি ইলিয়াস বিন নাজেম। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ফজরের নামাজ আদায় করার অভিজ্ঞতা ছিল গভীর ও প্রশান্ত। ভোরের ঠান্ডা বাতাস, মসজিদের মিনার আর নীরব প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে মনে হলো- সময়ের সমস্ত ব্যস্ততা যেন এখানেই থেমে গেছে। বহু বছর পেরিয়ে গেলেও এই মসজিদ তার পরিচিত রূপে দাঁড়িয়ে আছে, নীরবে সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ইবাদতের।
নামাজ শেষে হাঁটা শুরু করলাম ফেনী শহরের পরিচিত রাস্তাগুলো ধরে। প্রতিটি মোড়, দোকানপাট, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ- সবকিছু যেন একেকটি স্মৃতির দরজা খুলে দিচ্ছিল। হাঁটার ছন্দে ছন্দে মনে পড়ছিল অতীতের দিনগুলো, শহরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবনের নানা অধ্যায়। এভাবেই পৌঁছালাম পত্রিকা এজেন্ট মুহাম্মাদ রাজু আহমেদের কাছে। প্রয়োজনীয় পত্রিকা সংগ্রহ করে আবার পথ চলা শুরু করলাম। ছোট্ট এই কাজটিও যেন শহরের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে আমাকে নতুন করে যুক্ত করে দিল।
সকাল ১০টার দিকে ফেনী চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথে যেতে যেতে উপলব্ধি করলাম, ফেনী শহরের প্রতিটি দৃশ্য যেন নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। ভোরের হালকা রোদ, কুয়াশার আড়াল থেকে ভেসে আসা আজানের প্রতিধ্বনি, মানুষের ধীর পায়ের চলাচল- সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয় এক গভীর প্রশান্তির পরিবেশ। এই ভোরে শহরের জীবন, স্মৃতি আর আধ্যাত্মিকতা যেন এক বিন্দুতে এসে মিলেছে।
এই ভোরে এসে ব্যক্তিগত স্মৃতির কথাও মনে পড়ল। আমার জন্ম সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়নের পালগিরী গ্রামে। ফেনী শহরে চিকিৎসা প্র্যাকটিস, পারিবারিক বসবাস, কর্মজীবনের নানা অধ্যায়- সবকিছু মিলিয়ে এই শহর আমার জীবনের এক নীরব সঙ্গী হয়ে আছে। বর্তমানে চট্টগ্রামে বসবাস করলেও সাপ্তাহিক চেম্বার পরিচালনার সুবাদে ফেনীর সঙ্গে সম্পর্ক আজও জীবিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

