কোরআন হিফজ করার কিছু কার্যকর কৌশল
হাফেজ মাওলানা ক্বারী মেহেদী হাসান
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২১
কোরআন মহান রাব্বুল আলামিনের কালাম, যা সরাসরি আল্লাহপাক নিজেই শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন একটি চিরন্তন, শাশ্বত, মহাগ্রন্থ ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস এটি মহাসত্যের সন্ধানদাতা, সর্বশেষ ও সর্বাধুনিক ইলাহী কিতাব। এটি পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য জ্ঞান ও হেদায়াত লাভের উৎসমূল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 'তোমরা কোরআনকে আবশ্যক করে নাও। কেননা এটি। বিবেকের খোরাক, প্রজ্ঞার আলোকমালা, জ্ঞানের প্রস্রবণ, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বাধুনিক। আর আল্লাহ তাওরাতে বলেন, হে মুহাম্মাদ। আমি তোমার উপর সর্বাধুনিক কিতাব নাযিল করেছি, যা অন্ধের দৃষ্টিকে, বধিরের শ্রবণশক্তিকে। এবং অনুভূতিশূন্য বন্ধ হৃদয়ের বোধশক্তিকে উন্মোচিত করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা)
'কোরআন' শব্দের অর্থ পঠিত, তেলাওয়াতকৃত, যা সবকিছুকে শামিল করে। আর কোরআনকে 'কোরআন' এজন্যই বলা হয় যে, তাতে শুরু-শেষ, আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম, প্রতিশ্রুতি-ধমক, শিক্ষণীয় ঘটনাবলী, উপদেশ, দুনিয়া ও আখেরাতের সবকিছুর ইঙ্গিত রয়েছে। আর সেইসাথে রয়েছে আয়াতগুলির একে অপরের সাথে অনন্য সমন্বয় ও সুসামঞ্জস্য।
কোরআন শিক্ষা করা ও হিফজ করার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর কলামকে অন্তরে ধারণ করলে দ্বিগুণ সওয়াব মেলে। শয়তান থেকে সুরক্ষা ও জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ হয়। কোরআনের পাঠককে বলা হবে, 'তুমি যতটুকু কোরআন পড়েছো ততটুকু সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠো। যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ কোরআন পড়েছে সে আখেরাতে জান্নাতের সর্বশেষ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাবে।'
পবিত্র কোরআন হিফজ করা একটি অত্যন্ত বরকতময় এবং সম্মানের কাজ। এটি কেবল মুখস্থ করার বিষয় নয়, বরং আল্লাহর কালামকে অন্তরে ধারণ করা। দ্রুত এবং সফলভাবে হিফজ সম্পন্ন করার জন্য কিছু কার্যকর কৌশল।
১. নিয়ত এবং আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি:
সবকিছুর আগে আপনার উদ্দেশ্য বা নিয়ত পরিষ্কার হতে হবে। ইখলাস (একনিষ্ঠতা): শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হিফজ শুরু করুন। লোকদেখানো বা নামের মোহে নয়।
গুনাহ বর্জন : ইমাম শাফেঈ (রহ.) বলেছিলেন, ইলম হলো আলো, আর গুনাহ এই আলোকে নিভিয়ে দেয়। তাই হিফজ চলাকালীন চোখের এবং কানের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।
দোয়া : প্রতিদিন আল্লাহর কাছে সাহায্য চান যেন তিনি আপনার স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দেন এবং কাজটি সহজ করে দেন।
২. রুটিন ও সময়ের ব্যবস্থাপনা:
দ্রুত হিফজের জন্য সময়ের সঠিক ব্যবহার অপরিহার্য। সময় ব্যবহারের ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। একদিনে ১০ পৃষ্ঠা পড়ে পরের তিনদিন বিরতি দেওয়ার চেয়ে প্রতিদিন আধা পৃষ্ঠা পড়াও উত্তম। কোনোভাবেই রুটিন মিস করা যাবে না।
৩. হিফজ করার আধুনিক ও কার্যকর পদ্ধতি:
পড়াশোনা করার সময় নিচের এই ধাপগুলো অনুসরণ করতে পারেন।
আয়াতটি শোনা : নতুন কোনো অংশ মুখস্থ করার আগে দক্ষ কোনো ক্বারীর তিলাওয়াত ৪-৫ বার শুনুন। এতে আপনার উচ্চারণ ও তাজবিদ সঠিক হবে।
লিংকিং মেথড : একটি আয়াত মুখস্থ হলে দ্বিতীয় আয়াতটি পড়ুন। এরপর ১ ও ২ নম্বর আয়াত মিলিয়ে পড়ুন। এরপর ৩ নম্বর আয়াত পড়ুন এবং ১, ২ ও ৩ মিলিয়ে পড়ুন। এভাবে চেইনের মতো আগাতে হবে।
মুসহাফ বা নির্দিষ্ট কোরআন শরীফ : হিফজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একই ছাপা বা একই ফন্টের কোরআন ব্যবহার করুন। কারণ আমাদের মস্তিষ্ক পৃষ্ঠার গঠন এবং আয়াতের বিন্যাস ছবির মতো (Visual Memory) সেভ করে রাখে।
৪. রিভিশন বা 'মরাজা' (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ):
নতুন পড়ার চেয়ে পুরোনো পড়া মনে রাখা বেশি কঠিন। রিভিশনের জন্য নিম্মের কৌশলগুলো মানতে পারেন-
সালাতে তিলাওয়াত : দিনের মুখস্থ করা অংশগুলো সুন্নাত, নফল বা তাহাজ্জুদ নামাজে পড়ার চেষ্টা করুন। এটি মুখস্থ পড়াকে পাথরের মতো মজবুত করে দেয়।
পারস্পরিক তিলাওয়াত : আপনার কোনো বন্ধু বা সাথীর কাছে পড়া শোনান। ভুলগুলো অন্যের কানে দ্রুত ধরা পড়ে। বিশ্রামের সময় যাতায়াত বা বিশ্রামের সময় নিজের মুখস্থ অংশগুলো হেডফোনে শুনুন।
৫. শারীরিক ও মানসিক যত্নঃ
পুষ্টিকর খাবার : মধু, কালোজিরা, বাদাম এবং ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়।
পর্যাপ্ত ঘুম : রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুম কম হলে পড়া দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
সবরের (ধৈর্য) পরিচয় দেওয়া : মাঝেমধ্যে মনে হতে পারে পড়া
হচ্ছে না বা ভুলে যাচ্ছেন। এমন সময় ধৈর্য হারাবেন না। মনে রাখবেন, প্রতিটি হরফ পড়ার জন্য আপনি সওয়াব পাচ্ছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: "যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি হরফ পাঠ করবে সে একটি সওয়াব পাবে। আর এই একটি সাওয়াব ১০ টি সওয়াবের সমান।
আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। (তিরমিস্ত্রী
পরিশেষে বলবো, কোরআন হিফজ করা কোনো বীরত্ব নয়। এটি আল্লাহর সাথে একটি পবিত্র সম্পর্ক। আপনার গতি যাই হোক না কেন, প্রতিদিন লেগে থাকাই হলো আসল সফলতা। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : চেয়ারম্যান, মাশকুল কোরআন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, অনলাইন হিফজ মাদরাসা

