সুবিধাবাদী নেতানিয়াহু দায়িত্ব নেন না, শুধু কৃতিত্ব নেন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫, ১৪:০৪

নেতানিয়াহু আর কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ইসরায়েলে এখন এটাই বড় প্রশ্ন /ছবি : সংগৃহীত
ইরানের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে ইসরায়েলের ‘সফলতা’ শান্তির নতুন সুযোগ আনতে পারে- এমন ব্যাখ্যা দিয়েই পরিস্থিতি তুলে ধরেছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার সমর্থকেরা তখন সেটাই বিশ্বাস করেছিলেন।
ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা এই প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার (এক বিবৃতিতে) বলেন, ‘এই বিজয় শান্তি চুক্তির পরিসর নাটকীয়ভাবে বিস্তারের সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা তা নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে কাজ করছি।’
কিন্তু ৭৫ বছর বয়সী এই নেতার সমালোচকেরা ব্যাপারটি ভিন্নভাবে দেখছেন।
লন্ডনের চ্যাথাম হাউসের অধ্যাপক ইয়োসি মেকেলবার্গ বলেন, ‘নেতানিয়াহু যা-ই করেন, সবকিছুকেই নিজের সুবিধার জন্য ঘুরিয়ে নেন… এই মানুষটি কখনোই দায়িত্ব নেন না, শুধু কৃতিত্ব নেন…। তার সবকিছুই সুবিধাবাদী আর লেনদেনভিত্তিক।’
নেতানিয়াহু আর কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, ইসরায়েলে এখন এটাই বড় প্রশ্ন। দেশের মানুষ এখনো ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের ভয় আর আনন্দের রোলার কোস্টার থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছে না।
ইরানের যুদ্ধ আপাতত শেষ হলেও গাজার সংঘাত আবার শিরোনামে ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা করা যুদ্ধবিরতির পরদিনই দক্ষিণ গাজায় একটি সাঁজোয়াযানে হামলায় সাতজন ইসরায়েলি সেনা নিহত হন। ফলে গাজায় লড়াই বন্ধের দাবিও ইসরায়েলজুড়ে নতুন করে জোরালো হচ্ছে।
এর সঙ্গে ইসরায়েলি সমাজের গভীর বিভাজন আর নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২২ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের পর গঠিত জোটের টানাপোড়েনও আবার আলোচনায়। এটিই ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে কট্টরপন্থী সরকার। ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের আকস্মিক হামলায় ১২শ মানুষ নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি হওয়ার পর থেকেই সরকার একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।
ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের জনমত বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তামার হেরম্যান বলেন, এই যুদ্ধ আসলে দেশের মেরুকৃত রাজনীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারেনি।
তিনি বলেন, নেতানিয়াহুর সমর্থকেরা আগের চেয়ে আরও বেশি সমর্থন দিচ্ছেন আর বিরোধীরা আগের মতোই বিরোধিতা করছেন। ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধটিকে তারা সফল বলছেন, কিন্তু তার কৃতিত্ব নেতানিয়াহুকে দিচ্ছেন না। কিছু পয়েন্ট পেয়েছেন তিনি… কিন্তু খুব বেশি নয়।
নেতানিয়াহুর অনুগতদের আশা, এই যুদ্ধের জেরে জনমত জরিপে তার জনপ্রিয়তা বড় ধরনের উত্থান পাবে।
বর্তমান সরকারের একাধিক মন্ত্রীর প্রচার ব্যবস্থাপনা ও কৌশলগত উপদেষ্টা উদি তেনে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান অবশ্যই যৌক্তিক ছিল, কিন্তু এটাতে নেতানিয়াহু রাজনৈতিকভাবেও স্পষ্ট সুবিধা পেয়েছেন। রূপক অর্থে বলতে গেলে, ইরানের দিকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর কিছু ইসরায়েলের বিরোধী দলগুলোর ওপরও আঘাত হেনেছে।
তবে বড় প্রশ্ন হলো — এই ‘জয়’ ইসরায়েলিদের এতটাই প্রভাবিত করবে কি না যে তারা ২০২৩ সালের হামলার (দেশের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ব্যর্থতা) দায় ভুলে যাবে? এটা নেতানিয়াহুর শাসনকালেই ঘটেছিল।
উদি তেনে বলেন, সেই ভয়াবহ দিনের পর থেকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। ইরানের হুমকি নিষ্ক্রিয় হয়েছে, সিরিয়া প্রায় ভেঙে পড়েছে, হেজবুল্লাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, আর গাজা ধ্বংসপ্রায়। আমরা এক গভীর নিরাপত্তা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যার কৃতিত্ব অবশ্যই আইডিএফ (ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী) ও সরকারের প্রাপ্য।
তবে অনেকে এতে একমত নন। সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোও খুব একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে না। নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি কিছুটা সুবিধা পেলেও সেটি মূলত জোটের অন্যান্য, বিশেষত কট্টর-ডানপন্থী দলগুলোর থেকে এসেছে — এতে ভোটে জয়ের নিশ্চয়তা নেই।
সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচনের আগে ৯০ দিনের গ্যাপ বাধ্যতামূলক হওয়ায় হঠাৎ ভোট ডাকাও নেতানিয়াহুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যদিও তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কিছুটা বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জিউইশ ইনসাইডার-এর জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিবেদক লাহাভ হারকভ বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে নেতানিয়াহু বড় কৃতিত্ব পাচ্ছেন, জরিপেও তা দেখা যাচ্ছে। তবে মানুষ ৭ অক্টোবরের হামলা ভুলে যায়নি, আর রাজনীতির বিভাজনও কমেনি।
দীর্ঘ বিতর্কিত রাজনৈতিক জীবনে নেতানিয়াহুর কৌশলগত বুদ্ধি নিয়ে কখনোই প্রশ্ন ওঠেনি। তার সমর্থকেরা এখনো এর প্রশংসা করেন আর সমালোচকেরা আক্ষেপ করেন।
হারকভ বলেন, তার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দক্ষতা হলো— কীভাবে পরিস্থিতি টেনে নিয়ে যেতে হবে আর সময় কিনতে হবে তা তিনি ভালোই জানেন। আরেকটা দিন কীভাবে টিকে থাকতে হবে সেটা তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
ইসরায়েলের বিরোধী দলগুলোর উপদেষ্টারা বলছেন, সাম্প্রতিক জরিপগুলো তাদের আশা জাগাচ্ছে। তারা মনে করছেন, দুর্নীতির অভিযোগ, চলমান মামলার ঝুলে থাকা, ধর্মীয় ইহুদিদের সামরিক ছাড় নিয়ে দ্বন্দ্ব আর ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার খরচ এই ইস্যুগুলো নতুন নির্বাচনের সময় আবার সামনে চলে আসবে।
অনেকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভিত্তি একরকম নয়। সাম্প্রতিক সংঘাতের ফলে তার পরিবারের ওপর কী চাপ পড়েছে সে প্রসঙ্গে নেতানিয়াহুর কিছু মন্তব্য অনেকের মধ্যে ক্ষোভও তৈরি করেছে।
নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক পতন বহুবারই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, সর্বশেষ ২০২৩ সালের অক্টোবরেও। কিন্তু তিনি শুধু টিকে থাকেননি, প্রতিদ্বন্দ্বীদের একের পর এক কৌশলে হারিয়ে গেছেন। ইরানের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরুর আগের দিনই তার সরকার ফেলার চেষ্টা অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়েছিল।
মেকেলবার্গ বলেন, নেতানিয়াহুর জন্য একটা বড় সাফল্য খুবই প্রয়োজন ছিল। আমার মনে হয় না এই অভিযান আর তার দুর্নীতি মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ একইসঙ্গে হওয়া কোনো কাকতালীয় ঘটনা।
তবে অনুগতদের কাছে কোনো সংশয় নেই, পরের কয়েক বছরেও তিনিই থাকবেন নেতৃত্বে। উদি তেনে বলেন, ‘ডেভিড বেন-গুরিয়ন যদি ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা করে থাকেন, তাহলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করছেন।’
এ নিয়েই নেতানিয়াহুও আত্মবিশ্বাসী। সংসদের গ্রীষ্মকালীন বিরতির আগে হাতে আর কয়েক সপ্তাহ থাকলেও অন্তত আসন্ন শরৎ পর্যন্ত তিনি সময় কিনে ফেলেছেন।
গত সপ্তাহে তিনি বলেন, ‘আমার সামনে আরও অনেক লক্ষ্য রয়েছে, আর যতদিন মনে করব সেগুলো পূরণ করতে পারব, ততদিন চালিয়ে যাব।’
ওএফ