Logo

প্রযুক্তি

নিউজ পোর্টালের জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’ গুগল এআই সার্চ!

Icon

প্রযুক্তি ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯:৪১

নিউজ পোর্টালের জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’ গুগল এআই সার্চ!

গুগল সার্চ একসময় তথ্যের অবাধ প্রবাহের প্রতীক ছিল। আজ তা এক অপ্রত্যাশিত সংকটের মধ্যে ফেলে দিতে যাচ্ছে সকল তথ্য সূত্রগুলোকে। গুগলের সাম্প্রতিক এআই সার্চ মোড, ওয়েব পোর্টাল, ব্লগ পোস্ট এবং নিউজ কোম্পানিগুলোর জন্য কেবল একটি বড় দুঃসংবাদ নয়, বরং এটি তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রতি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই নতুন প্রযুক্তি, যা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের জীবনকে সহজ করছে, দীর্ঘমেয়াদে ইন্টারনেটের সমগ্র ইকোসিস্টেমকে বদলে করে দিতে পারে। এটি একটি পরজীবীর মতো কাজ করবে, যা ইন্টারনেটের উপর বেঁচে থাকবে, কিন্তু একই সাথে ইন্টারনেটে তথ্য ভাণ্ডারকেই ধীরে ধীরে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গুগলের এআই মোড আসলে কী? 
গুগলের এআই মোড হলো সার্চের একটি নতুন পদ্ধতি, যেখানে ব্যবহারকারী কোনো কিছু সার্চ করলে গুগল সরাসরি সার্চ বক্সেই সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে দেয়। এর জন্য কোনো লিঙ্ক ক্লিক করতে হয় না। আগে যেমন ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন ওয়েবসাইটের লিংকে ক্লিক করে তথ্য খুঁজতে হতো, এখন গুগল সেই প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলো নিজেই তুলে ধরছে অনেকটা চ্যাট জিপিটি বা জেমিনাইর মতো। এর অর্থ হলো, গুগল বলছে যে, আপনাকে কোনো ওয়েবসাইটে গিয়ে পড়ার দরকার নেই, সেই ওয়েবসাইটের সব তথ্য তো আমার কাছেই আছে, আমিই তথ্য সামারি করে  দিচ্ছি। এতে ব্যবহারকারীদের কাজ সহজ হচ্ছে এবং তারা দ্রুত তথ্য পাচ্ছেন।

পোর্টাল, ব্লগ পোস্ট এবং নিউজ সাইটগুলিকে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে? 
আপাতদৃষ্টিতে সুবিধাজনক ফিচারটি ওয়েব পোর্টাল, ব্লগ পোস্ট এবং নিউজ কোম্পানিগুলোর জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক হতে পারে। এই সার্চ ইঞ্জিনকে অনেকে প্যারাসাইট বা পরজীবীর সাথে তুলনা করছেন, যা বিভিন্ন সাইট থেকে তথ্য নিচ্ছে  কিন্তু সে সাইটে প্রবেশ করার তেমন কোনো লিঙ্ক দিচ্ছে না। গুগল হাতে গোনা যে সাইট থেকে তথ্য নিয়ে সামারি লিখে দিচ্ছে  শুধু সেই ৩/৪টি সাইটই পাশে সোর্স হিসে দেখিয়ে দিচ্ছে।

সাইটগুলো কিভাবে বিজ্ঞাপন হারাবে? 
যে কোনো ওয়েব পোর্টাল, ব্লগ বা নিউজ সাইটের আয়ের প্রধান উৎস হলো ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন। কিন্তু যখন গুগল তার এআই মোডের মাধ্যমে সরাসরি সার্চ ফলাফলেই সব তথ্য দেখিয়ে দেবে, তখন ব্যবহারকারীদের আর সেই ওয়েবসাইটগুলিতে ভিজিট করার প্রয়োজন পড়বে না। এর ফলে ওয়েবসাইটগুলিতে পাঠক বা ভিজিটরের সংখ্যা কমে যাবে। যদি পাঠক না আসেন, তাহলে তারা ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে পাবেন না। ফলস্বরূপ, বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয় মারাত্মকভাবে কমে যাবে, যা এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য টিকে থাকা কঠিন করে তুলবে।

সাইটের ট্র্যাফিক কিভাবে কমবে? 
ট্র্যাফিক হলো একটি ওয়েবসাইটে কতজন ব্যবহারকারী ভিজিট করছেন তার সংখ্যা। গুগলের এআই মোড এই ট্র্যাফিকের উপর সরাসরি আঘাত হানছে। যেহেতু গুগল নিজেই কোনো প্রশ্নের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক উত্তর বা খবরের সারাংশ তার সার্চ ফলাফলেই দিয়ে দিচ্ছে, তাই ব্যবহারকারীরা আর তথ্যের জন্য আলাদাভাবে কোনো ওয়েবসাইটে ক্লিক করে ঢুকবেন না। তারা সরাসরি গুগলের সামারি থেকেই তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাবেন। এটি ব্যবহারকারীদের জন্য কাজ সহজ করলেও, ওয়েবসাইটগুলোর জন্য এটি একটি মৃত্যুঘণ্টা সমতুল্য। কারণ, এতে তাদের ওয়েবসাইটের ভিজিটরের সংখ্যা বা ট্র্যাফিক ভয়াবহভাবে কমে যাবে।

এসইও করার প্রয়োজনীয়তা কেনো এবং কিভাবে হ্রাস পাবে?
সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনেরর প্রধান উদ্দেশ্যই হলো একটি ওয়েবসাইটকে সার্চ ইঞ্জিনের ফলাফলে ওপরের দিকে নিয়ে আসা, যাতে বেশি বেশি ব্যবহারকারী সেই সাইটে ক্লিক করে প্রবেশ করে এবং ট্র্যাফিক বাড়ে। কিন্তু যখন গুগল তার এআই সামারির মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার প্রয়োজনের দুয়ারই বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন এসইও’র চিরাচরিত কার্যকারিতাও হ্রাস পাবে বা বন্ধ হয়ে যাবে। আপনার কন্টেন্ট যত ভালোভাবেই অপটিমাইজ করা হউক না কেন, গুগল সেই কন্টেন্ট থেকে তথ্য নিয়ে নিজের সামারি তৈরি করবে ঠিকই কিন্তু ব্যবহারকারীকে আপনার ওয়েবসাইটে পাঠাবে না। গুগল নিজেই অডিয়েন্স ক্যাপচার করে নেবে। এর ফলে, ট্র্যাফিক আনার জন্য যে এসইও এতদিন অপরিহার্য ছিল, তা মূলত কার্যকারিতা হারাবে। 

 নিউজ ও ব্লগ সাইটগুলোর ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? 
এটিই সবচেয়ে ভীতিকর প্রশ্ন। যদি ওয়েবসাইটে ভিজিটর না আসে এবং আয় না হয়, তাহলে নিউজ পোর্টাল, ব্লগ এবং অন্যান্য কন্টেন্ট নির্মাতারা নতুন খবর, বিশ্লেষণ বা আর্টিকেল তৈরি করার প্রেরণা হারাবে? মানসম্মত কন্টেন্ট তৈরি করা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। আর্থিক প্রবাহ ছাড়া এই কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এর ফলস্বরূপ, ইন্টারনেটে মানসম্মত তথ্যের প্রবাহ  মারাত্তক ভাবে হ্রাস পাবে। যদি ওয়েবসাইট কর্তৃপক্ষ তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে গুগল ডেটা কোথা থেকে আনবে? যদি গুগল ডেটা না পায়, তাহলে সে নিজেও অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। অর্থাৎ, গুগল তার নিজের অস্তিত্বের জন্যই যে উৎসগুলো থেকে ডেটা নিচ্ছে, সেই উৎসগুলোকেই ধ্বংস করে নিজেরই অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

এই পরিস্থিতি ইন্টারনেটের সামগ্রিক ইকোসিস্টেমের জন্য একটি মহাবিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। যে ইন্টারনেট তথ্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার, তা গুগলের এই পরজীবী আচরণের কারণে ক্রোমশ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছে টেক বিশেষজ্ঞরা। ভেনম যেমন কাউকে শক্তিশালী করে, কিন্তু তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধ্বংস করে দেয়। ঠিক তেমনি, গুগল ইন্টারনেটকে শক্তিশালী করছে, কিন্তু ইন্টারনেটের চালিকা শক্তিগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই সংকট থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে না পেলে, অনলাইন কন্টেন্ট জগতের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যেতে পারে।

অনেকে আবার বলছে গুগল তার পথ ঠিকই বের করে রেখেছে। যা সাধারণ মানুষ টের পাবে অনেক পরে। পৃথিবীতে যত এআই মডেল আছে তারা প্রধানত উইকিপিডিয়া থেকে তথ্য নিয়ে তাদের এল এল এম মডেল তৈরি করে। অর্থাৎ এআইগুলোর প্রধান তথ্যভাণ্ডার হলো উইকিপিডিয়া। আর উইকিপিডিয়া কার? গুগলের। কিন্তু এখানে তথ্য কারা দেয়? না কোনো কোম্পানি না। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়া থাকা আইটি ইনথুজিয়াস্টরা। এরা গুগোলকে কন্ট্রিবিউট করে। তারা যেমন  উইকিপিডিয়াকে তথ্য দেয়, তারাই আবার তথ্যর ফ্যাক্টচেকও করে। যদি বলা হয় ইউটিউবে ভিডিও কারা দেয়? সহজ উত্তর সাধারণ ক্রিয়েটররা। তার জন্য তাকে নিজের আলাদা সাইট বানাতে হয় না। গুগলই  ইউটিউবের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ভিডিও পোস্ট করার সুযোগ করে দিয়েছে। এর জন্য সেই কন্টেন্ট মেকারের নিজের সাইট থাকার প্রয়োজন নেই। ঠিক তেমনিভাবে হয়ত গুগল এমন কোনো ব্যবস্থা করে দেবে যেন কোন সংবাদ মাধ্যমে না থেকেও মানুষ সরাসরি গুগলকে  অর্থের বিনিময়ে তথ্য প্রদান করবে। প্রত্যেকে হয়ে উঠবে নিজেই নিজের গণমাধ্যম।

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর