আর এফ আই ডি চিপ, নিরাপত্তার হাতিয়ার নাকি নজরদারির ফাঁদ?
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:৪৬
-68bfdef4b31c4.png)
ভাবুন তো, অফিসের গেটের সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল। লিফট আপনাকে চিনে নিল, বোতাম না টিপেই নিয়ে গেল আপনার ফ্লোরে। অফিস ক্যান্টিনে কফি কিনলেন, কিন্তু মানিব্যাগ খোলার দরকার হলো না। কারণ, আপনার শরীরের ভেতরেই বসানো আছে ক্ষুদ্র একটি চিপআর এফ আই ডি। চোখে দেখা যায় না, কিন্তু হাতের ইশারায় চারপাশের স্ক্যানারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সব কাজ সেরে ফেলে।
শুনতে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মতো মনে হলেও এটি এখন বাস্তব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যেই মানুষের শরীরে রোপণ করা হচ্ছে আর এফ আই ডি চিপ। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, নাগরিক পরিচয় যাচাই, ক্যাশলেস লেনদেন, জরুরি সময়ে চিকিৎসা , বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট , এমনকি নিখোঁজ শিশু বা প্রবীণদের খুঁজে বের করার মতো কাজে এই চিপ একদিন ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে।
সুইডেনের স্টকহোমে ‘এপিসেন্টার’ নামে একটি টেক হাবে কয়েকশ কর্মী হাতে চিপ বসিয়ে কাজ করছেন কয়েক বছর ধরে। সেই চিপ দিয়েই তারা দরজা খোলেন, কফি কিনেন, এমনকি অফিসের প্রিন্টারও ব্যবহার করেন। সুইডেনের রেলওয়ে একসময় টিকিট যাচাইয়েও ব্যবহার করেছিল এ প্রযুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৭ সালে উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের একটি কোম্পানিতে প্রায় ৫০ জন কর্মী স্বেচ্ছায় চিপ গ্রহণ করেন। আর মেক্সিকোতে উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারাও অপহরণ রোধ ও নিরাপত্তার জন্য চিপ বসিয়েছিলেন হাতে।
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কেভিন ওয়ারউইক ১৯৯৮ সালে প্রথম নিজের হাতে RFID চিপ বসিয়ে দেখান কীভাবে স্বয়ংক্রিয় দরজা খোলা, লাইট জ্বালানো যায়। প্রযুক্তির এই পরীক্ষাকে তিনি বলেছিলেন মানুষ আর যন্ত্রের মধ্যে নতুন সম্পর্কের সূচনা।
তবে সুবিধার পাশাপাশি উঠেছে নানা নিরাপত্তার প্রশ্ন। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ব্রুস শ্নেইয়ার সতর্ক করে বলেছেন, আর এফ আই ডি সহজেই দূর থেকে স্ক্যান করা যায়। ফলে যিনি চিপ বহন করছেন, তার অবস্থান, তথ্য বা পরিচয় অজান্তেই অন্যের হাতে চলে যেতে পারে। বায়োহ্যাকার আমাল গ্রাফস্ত্রা, নিজেই হাতে চিপ বসিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে স্বীকার করেছেন ভোক্তা পর্যায়ের আর এফ আই ডি ক্লোন বা নকল করা সম্ভব। অর্থাৎ কেউ চাইলে আপনার পরিচয় নকল করে এমন কাজ করতে পারে যার জন্য আপনি বিপদে পড়তে পারেন।
২০০৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য মানবদেহে ব্যবহারের অনুমোদন দিলেও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাণীদেহে ইমপ্ল্যান্ট করা চিপ টিউমারের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ফলে প্রযুক্তি উৎকর্ষের পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়েও বিতর্ক থেমে নেই।
গবেষক শোশানা জুবফ বলেন, মানুষের অভিজ্ঞতাকে যদি কেবল ডেটায় রূপান্তর করা হয়, তবে ব্যক্তিস্বাধীনতার অস্তিত্বই হারিয়ে যাবে। তাঁর মতে, গোপনীয়তা মানব মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত এটি বিলীন হয়ে গেলে মানুষ কেবল একটি ট্র্যাকড ডাটায় পরিণত হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি? আর এফ আই ডি চিপ নিঃসন্দেহে জীবনের অনেক কাজ সহজ করবে। হাসপাতাল থেকে অফিস, ব্যাংক থেকে বাজার সবখানেই এটি দ্রুত, ঝামেলাহীন ও স্মার্ট হতে দিতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি খুলে দিতে পারে এমন এক অন্ধকার দুয়ার, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের গতিবিধি, সিদ্ধান্ত, সরকারের বা কর্পোরেটের নজরদারিতে থাকবে।
শেষ দৃশ্যটা যেন ঘটে যেতে পারে সিনেমার মতো। একদিন হয়ত চিপ আপনার জীবন বাঁচাবে জরুরি সময়ে চিকিৎসককে আপনার চিকিৎসা রিপোর্ট প্রদান করে। আবার আরেকদিন হয়ত সেই একই চিপ আপনাকে আটকে দেবে স্কুল, ব্যাংক বা হাসপাতালের দরজায়। নিয়ন্ত্রণের সুইচ তখন আর আপনার হাতে থাকবে না।
আর এফ আই ডি চিপ, এটি কি কেবল ভবিষ্যতের প্রযুক্তি, নাকি মানুষের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ? উত্তর খুঁজতে হলে এখনই শুরু করতে হবে আলোচনার, তৈরি করতে হবে আইন ও নিরাপত্তার সঠিক কাঠামো। কারণ, প্রযুক্তি যেন কোনোভাবেই অভিশাপে রূপান্তরিত না হয়।