Logo

প্রযুক্তি

টেক জগতে ছাঁটাইয়ের মহামারি, ঝুঁকিতে বাংলাদেশও

মোহাম্মদ নেসার

মোহাম্মদ নেসার

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৫৯

টেক জগতে ছাঁটাইয়ের মহামারি, ঝুঁকিতে বাংলাদেশও

২০২৫ সাল যেন প্রযুক্তি খাতের জন্য দুঃসময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ প্রযুক্তি কর্মী চাকরি হারাচ্ছেন, আর এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও অটোমেশনের দ্রুত বিস্তার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপ, এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া সবখানেই একই অবস্থা। বাংলাদেশও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। গার্মেন্টস ও আইটি খাতে ইতোমধ্যে অটোমেশনের প্রভাব দৃশ্যমান, আর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বিশ্বজুড়ে ছাঁটাইয়ের ভয়াবহ চিত্র

২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি খাতে প্রায় ১,৮৪,০০০ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ছাঁটাই হয়েছে প্রায় ১,১২,০০০ জনের। ৪০০টিরও বেশি প্রযুক্তি কোম্পানি বড় থেকে ছোট, স্টার্টআপ থেকে টেক জায়ান্ট সবখানে কর্মী ছাঁটাইয়ের হিড়িক পরে গেছে।

কোন কোন দেশে ঘটছে এই ছাঁটাই মহামারি

কর্মী ছাঁটাইয়ের এই ঢেউ মূলত যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক হলেও এর প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ভারত, চীন, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া এসব দেশে বড় আকারের কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা দেখা গেছে। বিশেষ করে ভারতে প্রযুক্তি খাতের ছাঁটাই একটি বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রোর মতো আইটি জায়ান্টরা হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। চীনেও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো অটোমেশনের দিকে ঝুঁকছে এবং শ্রমিক সংখ্যা কমাচ্ছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, গুগলের মতো কোম্পানিগুলোর আঞ্চলিক অফিসেও ছাঁটাই হয়েছে। সিঙ্গাপুর, যেটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রযুক্তি হাব, সেখানেও টেক লেয়অফের খবর এসেছে।

কোন কোন কোম্পানিতে হচ্ছে ছাঁটাই

প্রযুক্তি জগতের প্রায় সব বড় নাম এই ছাঁটাইয়ের তালিকায় আছে। অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, ইন্টেল, মেটা (ফেসবুক), গুগল, সেলসফোর্স, আইবিএম, ইউপিএস, অ্যাকসেনচার এরা সবাই উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কর্মী ছাঁটাই করেছে।

অ্যামাজন : কোম্পানি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ছাঁটাই ঘটিয়েছে অ্যামাজন। ২০২৫ সালে ১৪,০০০ থেকে ৩০,০০০ কর্পোরেট কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। এআই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কোম্পানি খরচ কমাতে কর্মী বিদায়ে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে আমাজনের বস্থাপনা পরিষদ।

মাইক্রোসফট : ২০২৫ সালে মাইক্রোসফট প্রায় ১৫,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার, প্রোডাক্ট ম্যানেজার ও সাপোর্ট স্টাফ। কোম্পানির এআই কোপাইলট প্রজেক্টে বিপুল বিনিয়োগের ফলে অন্যান্য বিভাগে ছাঁটাই করা হয়েছে।

ইন্টেল : সেমিকন্ডাক্টর জায়ান্ট ইন্টেল প্রায় ২৪,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে, এটি তাদের মোট কর্মীর প্রায় ১৫ শতাংশ। কোম্পানির পুনর্গঠন ও এআই চিপ উৎপাদনে ফোকাস করতে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ইউপিএস : লজিস্টিকস কোম্পানি ইউপিএস প্রায় ৪৮,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে, যার মধ্যে ড্রাইভার, অপারেটর এবং ম্যানেজমেন্ট স্টাফ সবাই রয়েছে।

মেটা (ফেসবুক) : মার্ক জাকারবার্গের কোম্পানি মেটা ৩,৭২০ জন কর্মী ছাঁটাই করেছে, এই ধারাবাহিকতা এখন চলমান। কোম্পানি তাদের এফিশিয়েন্সি ইয়ার (efficiency year) ঘোষণা করে খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।

আইবিএম : প্রায় ৯,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে আইবিএম। তারা মূলত পুরনো আইটি সেবা থেকে এআই ও ক্লাউড সার্ভিসে স্থানান্তরিত হচ্ছে।

এ ছাড়াও রিভিয়ান, পেকম, স্ন্যাপ, টুইটার (এক্স), স্পটিফাই, নেটফ্লিক্স, পেপাল, জুম, স্ল্যাক এসব কোম্পানিতেও কর্মী ছাঁটাই চলছে।

কেন হচ্ছে এই ছাঁটাই? মূল কারণগুলো কী

প্রযুক্তি খাতে এই ব্যাপক ছাঁটাইয়ের পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

১. এআই ও অটোমেশনের বিস্তার।

সবচেয়ে বড় কারণ হলো এআই ও অটোমেশন। ২০২৫ সালের ছাঁটাইয়ের প্রায় ২৭ শতাংশ সরাসরি এআই দ্বারা মানুষের কাজ প্রতিস্থাপনের কারণে হয়েছে। কোম্পানিগুলো এখন চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনাই, মাইক্রোসফট কোপাইলটের মতো এআই টুল ব্যবহার করে এমন কাজ মুহূর্তেই করে ফেলছে যা করতে আগে ১০ জন মানুষ দরকার ছিল।

বাস্তব উদাহরণ : সফ্‌টওয়্যার টেস্টিং, কাস্টমার সার্ভিস, ডেটা এন্ট্রি, কন্টেন্ট মডারেশন, এমনকি কোড লেখা পর্যন্ত এই সব কাজে এখন এআই ব্যবহার হচ্ছে। ফলে এসব পদে মানব কর্মীর চাহিদা কমে গেছে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কাস্টমার সার্ভিস সেক্টরে এআই চ্যাটবট ব্যবহারের ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মী বাদ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। একইভাবে, সফ্‌টওয়্যার ডেভেলপমেন্টে এআই টুল ব্যবহার করে কোম্পানিগুলো জুনিয়র ডেভেলপার ও কিউএ (QA) ইঞ্জিনিয়ারদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে।

২. অর্থনৈতিক মন্দা ও ব্যয় সংকোচন।

এটি স্পষ্ট যে বিশ্বে এখন অর্থনীতি মন্দা চলছে। উচ্চ সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতি, এবং ভোক্তা ব্যয় কমে যাওয়ার কারণে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর লাভের খাতে চাপ পড়েছে। ফলে তারা খরচ কমাতে ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিচ্ছে।

৩. পান্ডেমিক-পরবর্তী সংশোধন।

কোভিড-১৯ পান্ডেমিকের সময় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ব্যাপক হারে কর্মী নিয়োগ দিয়েছিল। ডিজিটাল সেবার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তারা ধরে নিয়েছিল এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। কিন্তু পান্ডেমিক-পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসায় সেই চাহিদা কমে গেছে। ফলে ওভারহায়ারিং (overhiring) সংশোধনের জন্য ছাঁটাই করতে হচ্ছে।

৪. বিনিয়োগকারীদের চাপ ও মুনাফায় ফোকাস

স্টক মার্কেটের চাপ ও শেয়ারহোল্ডারদের সন্তুষ্ট রাখতে কোম্পানিগুলো লিন অপারেশন (lean operation) বা কম খরচে বেশি কাজ করার মডেল অনুসরণ করছে। ছাঁটাই ঘোষণার পর অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে যায়, যা কোম্পানিগুলোকে এই পন্থা অবলম্বনে উৎসাহিত করে।

৫. স্ট্র্যাটেজিক রিস্ট্রাকচারিং

অনেক কোম্পানি তাদের ব্যাবসায়িক কৌশল পরিবর্তন করছে। যেমন, পুরনো প্রোডাক্ট বা সার্ভিস বন্ধ করে নতুন এআই কেন্দ্রিক প্রোডাক্টে ফোকাস করছে। এই রূপান্তরের সময় যে-সব কর্মীর স্কিল নতুন কাজের সাথে মিলছে না, তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে।

এআই কি সত্যিই মানুষের চাকরি দখল করছে?

এক কথায় উত্তর, হ্যাঁ। এআই এখন শুধু ভবিষ্যতের হুমকি নয়, বর্তমানেরও বাস্তবতা। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (World Economic Forum) এর ফিউচার অফ জবস রিপোর্ট ২০২৫ অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ মিলিয়ন চাকরি এআই ও অটোমেশন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে। তবে ইতিবাচক দিকও আছে। একই রিপোর্ট এটাও বলছে যে, এআই নতুন ৯৭ মিলিয়ন চাকরি সৃষ্টি করবে। তবে সেগুলো হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের চাকরি, যার জন্য প্রয়োজন নতুন স্কিল।

কোন কোন চাকরি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে?

বেশি ঝুঁকিতে আছে : ডেটা এন্ট্রি অপারেটর, কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভ, টেলিমার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং ক্লার্ক, সফ্‌টওয়্যার টেস্টার (জুনিয়র লেভেল), কন্টেন্ট মডারেটর, অনুবাদক (বেসিক লেভেল), গ্রাফিক ডিজাইনার (টেমপ্লেট বেসড)

মধ্যম ঝুঁকিতে : সফ্‌টওয়্যার ডেভেলপার (জুনিয়র), ডিজিটাল মার্কেটার, এইচআর রিক্রুটার, ফিনান্সিয়াল অ্যানালিস্ট, কন্টেন্ট রাইটার। 

কম ঝুঁকিতে : সিনিয়র সফ্‌টওয়্যার আর্কিটেক্ট, প্রোডাক্ট ম্যানেজার, ইউএক্স (UX) রিসার্চার, ডেটা সায়েন্টিস্ট, সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট, এআই/এমএল (ML) ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি।

চাকরি ছাঁটাইয়ের মানবিক প্রভাব

সংখ্যার আড়ালে লুকিয়ে আছে লাখ লাখ মানুষের জীবনের গল্প। চাকরি হারানোর মানসিক চাপ অত্যন্ত গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী।

মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব

গবেষণায় দেখা গেছে, টেক লেয়অফের শিকার হওয়া কর্মীদের মধ্যে :

৬৮ শতাংশ উদ্বেগ (anxiety) ও বিষণ্নতায় (depression) ভোগেন।

৫৪ শতাংশ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন।

৪৩ শতাংশ ঘুমের সমস্যায় ভোগেন।

৩৭ শতাংশ পারিবারিক সম্পর্কে টানাপড়েন অনুভব করেন। 

বিশেষত প্রযুক্তি পেশাজীবীরা, যারা নিজেদের হাই পারফরমার হিসেবে দেখতেন, তারা হঠাৎ চাকরি হারিয়ে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস (identity crisis) এ পড়ে যান।

বিশ্বব্যাপী প্রতিকারমূলক উদ্যোগ

এই সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা নানা উদ্যোগ নিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন:

এআই অ্যাক্ট (AI Act) ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৫ সালে বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ এআই নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করেছে। এই আইনে:

কর্মচারীদের অধিকার সুরক্ষার বিধান।

এআই ব্যবহারে স্বচ্ছতা (transparency) বাধ্যতামূলক।

বায়াসড (biased) এআই সিস্টেম নিষিদ্ধ।

চাকরিচ্যুত কর্মীদের জন্য পুনর্প্রশিক্ষণ সহায়তা ইত্যাদি বিষয়ে বাধ্যতামূলক দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

রিস্কিলিং প্রোগ্রাম : 

ইউরোপীয় দেশগুলো ব্যাপক রিস্কিলিং কর্মসূচি চালু করেছে। জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস সরকারি তহবিল থেকে কর্মীদের নতুন স্কিল শেখার জন্য অনুদান দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ও স্টেট লেভেলে বিভিন্ন উদ্যোগ চলছে :

ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার (Department of Labor) এর মাধ্যমে জব ট্রানজিশন সাপোর্ট।

টেক কোম্পানিগুলোর নিজস্ব রিস্কিলিং প্রোগ্রাম গুগল ক্যারিয়ার সার্টিফিকেট, মাইক্রোসফট লার্ন, আইবিএম স্কিলসবিল্ড প্রোগ্রাম।

বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (World Economic Forum) রিস্কিলিং রেভোলিউশন (Reskilling Revolution) নামে একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ চালু করেছে, যার লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ১ বিলিয়ন মানুষকে নতুন স্কিল শেখানো।

এশিয়া-প্যাসিফিক

ভারত, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া এসব দেশ জাতীয় স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করেছে। বিশেষত এআই, ডেটা অ্যানালিটিক্স, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবার সিকিউরিটি এসব বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশে এখনো পশ্চিমা দেশগুলোর মতো ব্যাপক প্রযুক্তি ছাঁটাই শুরু হয়নি, তবে সতর্কতার ঘণ্টা বেজে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের এআই রেডিনেস (AI readiness) খুবই কম, যা ভবিষ্যতে তরুণ কর্মীবাহিনীকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

গার্মেন্টস সেক্টরে অটোমেশনের প্রভাব

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে ইতোমধ্যে অটোমেশনের প্রভাব দৃশ্যমান। সাম্প্রতিক গবেষণায় চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে, গার্মেন্টস সেক্টরে অটোমেশনের ফলে প্রায় ৩০.৫৮ শতাংশ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন বা ঝুঁকিতে আছেন।

যন্ত্রচালিত কাটিং, সেলাই, ফিনিশিং এসব প্রক্রিয়ায় অটোমেশন আসায় বিশেষত মহিলা ও এন্ট্রি লেভেল কর্মীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। বয়স্ক কর্মী (৪০+ বছর) এবং কম শিক্ষিত শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।

উদাহরণ : একটি বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অটোমেটেড কাটিং মেশিন চালু করার হল। যেখানে আগে ৫০ জন শ্রমিক কাজ করতেন, এখন মাত্র ১৫ জন প্রয়োজন হবে। বাকি ৩৫ জনকে ছাঁটাই করা হবে অথবা অন্য বিভাগে স্থানান্তর করা হবে আর কম বেতনে।

আইটি ও বিপিও সেক্টর

বাংলাদেশের আইটি ও বিপিও (BPO) সেক্টরও এআই ও অটোমেশনের চাপে আছে। কাস্টমার সার্ভিস, ডেটা এন্ট্রি, কল সেন্টার এসব কাজে এআই চ্যাটবট ও অটোমেশন টুল ব্যবহার বাড়ছে।

তবে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে একটু ভাগ্যবান, বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ এআই জনিত চাকরি ঝুঁকিতে তুলনামূলক কম এক্সপোজড (exposed)। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো অনেকাংশে শ্রমনির্ভর (labour-intensive), উচ্চ-প্রযুক্তি নির্ভর চাকরির অনুপাত এ দেশে কম।

দক্ষতার ঘাটতি : বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো স্কিল গ্যাপ। দেশের প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা এখনো পুরনো পদ্ধতিতে আটকে আছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্ব যখন এআই যুগে প্রবেশ করছে, বাংলাদেশ তখনো এক্সেল যুগের প্রশিক্ষণে আটকে আছে।

বাস্তবতা হলো:

দেশের বেশিরভাগ টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে পুরনো  আইডিয়া আর পুরনো কম্পিউটার ও সফ্‌টওয়্যার ব্যবহার হয়।

আধুনিক প্রযুক্তি যেমন ক্লাউড, এআই, মেশিন লার্নিং, ডেটা সায়েন্স এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত।

চাকরিদাতারা যে স্কিল চাইছেন, আর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যা শেখানো হচ্ছে এই দুইয়ের মধ্যে বিশাল ব্যবধান।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ : কী অপেক্ষা করছে?

বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জিং তবে আশাহীন নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বড় আকারের ছাঁটাই এড়াতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশে ঝুঁকির আকার :

একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট চাকরির প্রায় ৬০ শতাংশ অটোমেশন দ্বারা ঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষত :

গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল : ৪৫-৫০ শতাংশ।

ব্যাংকিং ও ফিনান্স : ৩৫-৪০ শতাংশ।

ট্রান্সপোর্ট ও লজিস্টিকস: ৪০-৪৫ শতাংশ।

প্রশাসনিক ও ক্লেরিক্যাল কাজ : ৫০-৫৫ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট রিপোর্টে সতর্ক করা হয়েছে : বাংলাদেশের কম এআই রেডিনেস তরুণ কর্মীবাহিনীকে ঝুঁকিতে ফেলছে। দেশের ৬৫ শতাংশ জনসংখ্যা ৩৫ বছরের নিচে, এবং তারা যদি আধুনিক স্কিল না শিখতে পারেন, তাহলে বেকারত্ব মারাত্মক আকার নিতে পারে।

সম্ভাবনার দিক :

তবে আশার কথাও আছে। বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী প্রযুক্তিতে আগ্রহী এবং দ্রুত শেখার ক্ষমতা রাখে। সঠিক নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ পেলে তারা বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম।

ফ্রিল্যান্সিং, রিমোট ওয়ার্ক, আউটসোর্সিং এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুনাম আছে। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে উচ্চ-দক্ষতার কাজে প্রবেশ করা সম্ভব।

বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ

বাংলাদেশ সরকার এআই ও অটোমেশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যদিও বাস্তবায়নের গতি ধীর।

জাতীয় কৌশল :

ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স: সরকার ২০২৫ সালে একটি জাতীয় এআই কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে, যেখানে এআই গবেষণা, প্রশিক্ষণ, এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য রোডম্যাপ দেওয়া আছে।

মূল লক্ষ্য :

জাতীয় এআই রিসার্চ সেন্টার স্থাপন।

৫,০০০ এআই বিশেষজ্ঞ তৈরি।

সরকারি সেবায় এআই প্রয়োগ।

স্কিলস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম

স্কিলস ফর অ্যামপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (SEIP) : এই প্রকল্পের মাধ্যমে তরুণদের আইটি, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক ডিজাইন ইত্যাদি বিষয়ে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

তবে এই প্রোগ্রামের সীমাবদ্ধতা আছে : প্রশিক্ষণের মান তুলনামূলক কম, আধুনিক প্রযুক্তি (এআই, ক্লাউড, মেশিন লার্নিং) এর প্রশিক্ষণ সীমিত, বাস্তবসম্মত চাকরি ক্ষেত্র কম।

গার্মেন্টস সেক্টর :

সরকার ও গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ (BGMEA) অটোমেশন প্রভাবিত শ্রমিকদের জন্য রিট্রেনিং প্রোগ্রাম চালু করেছে। তবে বাস্তবায়ন এখনো শুরুর পর্যায়েই রয়ে গেছে।

স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তা সহায়তা

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয় স্থানীয় টেক স্টার্টআপদের জন্য ফান্ড ও ইনকিউবেশন সাপোর্ট দিচ্ছে। ২০২৫ সালে প্রায় ২,৫০০ স্টার্টআপকে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে।

চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

তবে সরকারি উদ্যোগের বাস্তবায়নে বেশ কিছু সমস্যা আছে :

বাজেট বরাদ্দ অপর্যাপ্ত।

আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের অভাব।

প্রশিক্ষণের মান ও আধুনিকায়নে ঘাটতি।

বেসরকারি খাতের সাথে সংযোগের দুর্বলতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাগজে-কলমে পরিকল্পনা আছে, কিন্তু মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে গতি আনা জরুরি।

বাংলাদেশ যদি আসন্ন অটোমেশন সংকট মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।

ব্যক্তি পর্যায়ে : 

নিজেকে রিস্কিল করুন : তরুণদের এআই, ডেটা সায়েন্স, ক্লাউড কম্পিউটিং, সাইবার সিকিউরিটি এসব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেমন কোর্সেরা (Coursera), ইউডেমি (Udemy), লিংকডইন লার্নিং (LinkedIn Learning) এগুলো ব্যবহার করে নিজেকে রিস্কিল করা যেতে পারে।

সফট স্কিল বাড়ান : শুধু টেকনিক্যাল স্কিল নয়, কমিউনিকেশন, প্রবলেম সল্ভিং, ক্রিটিক্যাল থিংকিং এসব সফট স্কিলও গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে

-কোম্পানিগুলোর উচিত :

-কর্মীদের রিস্কিলিং এ বিনিয়োগ করা।

-জাস্ট ট্রানজিশন (just transition) নীতি মেনে চলা অর্থাৎ, অটোমেশন আনলেও কর্মীদের যথাযথ সহায়তা দেওয়া।

-মানব ও এআই কোলাবরেশন মডেল তৈরি করা।

সরকারি পর্যায়ে

সরকারের জরুরি পদক্ষেপ :

- শিক্ষা কারিকুলামে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা।

- ম্যাসিভ রিস্কিলিং প্রোগ্রাম চালু করা।

- এআই রেগুলেশন ও শ্রমিক সুরক্ষা আইন তৈরি করা। 

- পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ জোরদার করা।

টেক জগতে ছাঁটাইয়ের মহামারি এখন আর ভবিষ্যতের কল্পনা নয়, এটি বর্তমানের কঠিন বাস্তবতা। বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন, আর এর পেছনে মূল চালক হিসেবে কাজ করছে এআই ও অটোমেশন। বাংলাদেশও এই ঝড়ের বাইরে নেই। গার্মেন্টস সেক্টরে ইতোমধ্যে অটোমেশনের প্রভাব পড়েছে, আর আইটি ও অন্যান্য খাতেও এই চাপ বাড়ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার চেয়ে প্রস্তুত হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সরকার, বেসরকারি খাত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সবাইকে মিলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দক্ষতা উন্নয়ন, আধুনিক প্রশিক্ষণ, নীতিগত সহায়তা এসবের সমন্বয়েই কেবল আমরা এআই যুগে টিকে থাকতে পারব। মনে রাখতে হবে, এআই মানুষের প্রতিপক্ষ নয়, বরং সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এটি হতে পারে আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সহায়ক। প্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, যথোপযুক্ত প্রস্তুতি এবং নিরন্তর শেখার মানসিকতা।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম মেধাবী ও উদ্যমী। সঠিক সুযোগ ও নির্দেশনা পেলে তারা এই চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তরিত করতে পারবে।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

প্রযুক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর