এআই বদলে দিচ্ছে দেশের অর্থনীতি : স্বাস্থ্য থেকে কৃষি সবখানে বিপ্লব
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:১২
ছবি : বাংলাদেশের খবর গ্রাফিক্স
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি এখন আর ভবিষ্যতের কল্পনা নয়, এটি বর্তমান বাস্তবতা। ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি ও ডিজিটাল মার্কেটিং খাতে এআইয়ের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জনগণের দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই পরিবর্তনগুলো শুধু মাত্র প্রযুক্তিগত উন্নয়নই নয়, এটি আর্থিক উন্নয়ন থেকে শুরু করে খাদ্য নিরাপত্তা পর্যন্ত বিভিন্ন সমাধান সমাধান।
স্বাস্থ্যসেবায় এআইয়ের বিপ্লব -
স্বাস্থ্য এআই : ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার নতুন মাত্রা
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ডিজিটালাইজেশনের সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ হলো, স্বাস্থ্য এআই (Shastho AI) প্ল্যাটফর্ম। এই এআই চালিত স্বাস্থ্যসেবা অ্যাপ্লিকেশনটি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, বুকিং থেকে শুরু করে, ঘরে বসে ল্যাব পরীক্ষা সংগ্রহ পর্যন্ত সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সমাধান প্রদান করছে। প্ল্যাটফর্মটি ৬৫টিরও বেশি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত, ব্যবহারকারীদের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ২০% পর্যন্ত ছাড় এবং হাসপাতালের বিল ২০-৫০% পর্যন্ত সাশ্রয় করার সুযোগ দিচ্ছে।
সুস্থ.এআই: কিশোর স্বাস্থ্যের জন্য প্রথম বাংলা মেডিকেল এআই
বাংলাদেশে বিকশিত প্রথম বাংলা ভাষার মেডিকেল এআই সুস্থো.এআই (SuSastho.AI) বিশেষভাবে কিশোরদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য, নারী অধিকার এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তথ্য প্রদান করছে। বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের তহবিলে তৈরি এই প্ল্যাটফর্মটি পরীক্ষামূলক ব্যবহারে ৯০% এর বেশি নির্ভুলতা দিয়েছে। এটি সামাজিক লজ্জা এবং সংস্কৃতির বাধা অতিক্রম করে তরুণদের সঠিক স্বাস্থ্য তথ্য প্রদান করছে।
গ্রামীণ এলাকায় টেলিমেডিসিন সমাধান
বাংলাদেশের দূরবর্তী এবং গ্রামীণ এলাকায় এআই চালিত স্মার্ট ডিভাইস এবং টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্ম প্রবীণ নাগরিক ও গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং দ্রুত চিকিৎসা পরামর্শ পেতে সাহায্য করছে। এই প্রযুক্তি দূরবর্তী এলাকায় থাকা মানুষগুলোকে শহরের মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা পাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে, যা দেশের স্বাস্থ্য বৈষম্য কমাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।
ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন-
এআই-ভিত্তিক ক্রেডিট স্কোরিং এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি
বাংলাদেশের মাইক্রোফাইন্যান্স ও ছোট ঋণ বিতরণে এআই চালিত ক্রেডিট স্কোরিং সিস্টেম বিপ্লব ঘটাচ্ছে। সনাতন ক্রেডিট স্কোরিং মডেল অনেক গ্রাহককে ডকুমেন্টের অভবে ঋণ প্রদান করে না। কারণ অনেকের ফর্মাল ব্যাংক হিস্টোরি থেকে না। কিন্তু ডানা ফিনটেক (Dana Fintech) এর মতো কোম্পানিগুলো এখন এআই ব্যবহার করে গ্রাহকদের মোবাইল পেমেন্ট ইতিহাস, লেনদেনের ধরন এবং আর্থিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে তাদের ঝুঁকি মূল্যায়ন করছে।
এর ফলে একজন রিক্সাচালক, ছোট দোকানদার বা মৌসুমি কৃষিকর্মী যাদের কোনো ফর্মাল ডকুমেন্টেশন নেই, তারাও এখন মাত্র তিন মিনিটে ডিজিটাল ঋণের অনুমোদন পেতে পারেন। ডানা ফিনটেকের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই পদ্ধতি ব্যাংক এবং মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের প্রক্রিয়ার সময় ৭৫% কমিয়েছে এবং মাসিক নতুন গ্রাহক ১৫% বৃদ্ধি করেছে।
জালিয়াতি প্রতিরোধে এআইয়ের ভূমিকা
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দেশের প্রধান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এআই চালিত জালিয়াতি শনাক্তকরণ ব্যবস্থা প্রয়োগ করছে। এই সিস্টেমগুলো রিয়েল টাইম লেনদেন পর্যবেক্ষণ করে এবং অস্বাভাবিক কার্যকলাপ শনাক্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি ডেবিট কার্ড একই সাথে ঢাকা এবং নিউইয়র্কে ব্যবহার হয়, এআই তাৎক্ষণিকভাবে সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে ফ্ল্যাগ করে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক নির্দেশনা
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৫ সালে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অনলাইন জুয়া ও অবৈধ লেনদেন সনাক্তকরার জন্য এআই প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। এই নীতি শুধু মাত্র নাগরিক সম্পদ রক্ষা করছে না, বরং ডিজিটাল ব্যাংকিং সিস্টেমকে আরও নিরাপদ করছে। ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার বলেছেন, 'এআই ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো সহজে অস্বাভাবিক কার্যক্রম, ম্যালওয়্যার ও জালিয়াতি কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে পারবে'।
দেশের কৃষিতে এআই যুগ-
ড্রোন প্রযুক্তি এবং নির্ভুল কৃষি
বাংলাদেশের কৃষকরা এখন এআই সংযুক্ত ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। এই ড্রোনগুলো মাল্টিস্পেক্ট্রাল এবং হাইপারস্পেক্ট্রাল ক্যামেরা দিয়ে মাটির পুষ্টি অবস্থা, ফসলের রোগের প্রাথমিক লক্ষণ এবং জলের চাহিদা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে।
ফলনের পূর্বাভাস ও জলবায়ু তথ্য
এআই চালিত উৎপাদন পূর্বাভাস মডেল বাংলাদেশের কৃষকদের ৮৫% এর বেশি নির্ভুলতার সাথে ফসলের উৎপাদন পূর্বাভাস দিতে পারে। এই সিস্টেমগুলো স্থানীয় জলবায়ু, মাটির ধরন এবং আবহাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত ফসল চাষের তথ্য প্রদান করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা এবং অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের সম্ভাবনা বাড়ছে। এক্ষেত্রে এআই সতর্কতা সিস্টেম কৃষকদের ফসলের ক্ষতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
খরচ কমানো এবং পরিবেশ সুরক্ষা
এআই প্রযুক্তি কৃষকদের সার, কীটনাশক এবং সেচের জল ব্যবহার অপ্টিমাইজ করতে সাহায্য করছে। ফলে উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে এবং পরিবেশের ক্ষতি হ্রাস পাচ্ছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে, কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারদের ড্রোন এবং স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে নিয়মিত জমি মূল্যায়ন করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে এআইয়ের প্রভাব-
টার্গেটেড মার্কেটিং এবং গ্রাহক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের ডিজিটাল মার্কেটিং খাতে এআই ব্যবহার গত দুই বছরে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এআই অ্যালগরিদম এখন গ্রাহকদের ব্রাউজিং হিস্টোরি, ক্রয় প্যাটার্ন এবং অনলাইন আচরণ বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে কার্যকর বিজ্ঞাপন তৈরি ও প্রদর্শন করতে পারে। এর ফলে বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইনের রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কনটেন্ট অটোমেশন এবং কাস্টমাইজেশন
এআই চালিত কনটেন্ট জেনারেশন টুলস ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপন কপি, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট এবং ই-মেইল ক্যাম্পেইন দ্রুত তৈরি করতে সাহায্য করছে। এক্সপার্টদের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের ই-কমার্স এবং ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরে এআই ব্যবহারকারী কোম্পানিগুলো সনাতন পদ্ধতি ব্যবহারকারীদের তুলনায় ৩০-৪০% বেশি বিক্রয় করছে।
বর্তমান চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে এআই সেবা গ্রহণে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন : ডেটা গোপনীয়তা নিশ্চিতকরণ, এআই সিস্টেমের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষিত এআই বিশেষজ্ঞের অপ্রতুলতা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত নীতিমালা আপডেট করছে এবং দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেছেন, 'আগামী ১০-১৫ বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবোটিক্স মানুষের জীবনের সাথে সহাবস্থান করবে। তাই এখনই আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনা প্রয়োজন'। বাংলাদেশের আইটি খাত ইতোমধ্যে বৈশ্বিক এআই ট্যালেন্ট পুলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে এবং দেশীয় স্টার্টআপগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারে এআই সার্ভিস রপ্তানি করছে।
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুধু মাত্র প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি মাধ্যম হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে কৃষি, ব্যাংকিং থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং সর্বত্র এআই প্রযুক্তি অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ আছে, কিন্তু বাংলাদেশ এই ডিজিটাল বিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি উন্নত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
তথ্য: বিভিন্ন বিশ্বস্ত ও সাম্প্রতিক ওয়েবসাইট, প্রতিবেদন, ও বিশ্লেষণ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্ম যেমন শাস্থো (Shastho AI), বিভিন্ন রিপোর্ট, সরকারী নির্দেশনা, এবং প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণা ও নিউজ আউটলেটের তথ্য রয়েছে। এই সোর্সগুলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, কৃষি, ও ডিজিটাল মার্কেটিং ক্ষেত্রে এআই ব্যবহারের বাস্তব উদাহরণ এবং প্রভাবের উপর ভিত্তি করে তথ্য সরবরাহ করেছে।


