Logo

সারাদেশ

নিয়ম না মেনে গড়ে ওঠা নগর সাভার, ভবন ধসের শঙ্কা

আরিফুল ইসলাম সাব্বির

আরিফুল ইসলাম সাব্বির

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:২৯

নিয়ম না মেনে গড়ে ওঠা নগর সাভার, ভবন ধসের শঙ্কা

ছবি : বাংলাদেশের খবর

দিন দিন ঘিঞ্জি নগরে পরিণত হচ্ছে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সাভার। গড়ে উঠছে একের পর এক ভবন। যার বেশির ভাগই অনুমোদনহীন, অবৈধ। নিয়ম না মেনে গড়ে ওঠা ভবনে তৈরি হয়েছে দুর্ঘটনা ঝুঁকি। এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হলে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তথ্য বলছে, সাভারে ভবন নির্মাণ দেখভাল করার কথা সাভার পৌরসভা ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। সাভার পৌর কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী, সর্বোচ্চ সাততলা ভবন নির্মাণ করা যাবে সাভারে। 

সাভারে ইমারত নির্মাণ লে-আউট পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০৩-২০০৪ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সাভার পৌরসভা ৭,৬৯৮টি ভবনের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে শিল্পকারখানাও আছে। কিন্তু অনুমোদন নেই এমন ভবনের সংখ্যা জানা নেই কর্তৃপক্ষের।

অন্যদিকে, বহুতল ভবনের অনুমোদন দেয় রাজউক। ২০০৬ সালে রাজউকের এক জরিপ অনুযায়ী, সাভারে অবকাঠামো ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ১০টি। পরে ২০১৬ সালের আরেক জরিপে দেখা যায়, অবকাঠামো দ্বিগুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ১ হাজার ৬৫৩টি। গত নয় বছরে অবকাঠামো আরও বেড়েছে।

এদিকে, সাভারের বিভিন্ন এলাকায় বের হলেই ৬ তলা থেকে ১০ তলা ভবন চোখে পড়ে। এমনকি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোও এমন ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছে। 

সরেজমিনে উপজেলার ব্যাংক কলোনি, রেডিও কলোনি, থানা রোড, বাজার রোড, শিমুলতলা, রাজাসন এলাকায় দেখা যায়, বহু ভবন ৬ তলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে। বহু ভবনের দুই পাশে পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হয়নি, নেই পার্কিং সুবিধাও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরু থেকেই সাভার এক অপরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে উঠেছে। আর নিয়ম না মেনে গড়ে ওঠা শহরটি তীব্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে। এ জন্য তারা ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল উপজেলার রানা প্লাজা ধসের ঘটনা উল্লেখ করেন। ওই ঘটনায় ১১৭৫ শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক। সেই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবসে তাই সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন- এমন দুর্ঘটনা থেকে কতটা শিক্ষা নিল নগরবাসী ও কর্তাব্যক্তিরা?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মো. আকতার মাহমুদ বলেন, ‘সাভার পৌরসভার ভেতরে যে ভবনগুলো নির্মাণ হচ্ছে, যদিও সেগুলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অধিভুক্ত এলাকা, কিন্তু এখানে একটা স্থানীয় সরকার রয়েছে, সাভার পৌরসভা। তাদেরও এটা দেখভাল করার কথা। কিন্তু না রাজউক পারছে, না সাভার পৌরসভা পারছে। সাভারে যত ধরনের বাড়িঘর হচ্ছে, ভবন হচ্ছে কোনোটিই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না।’

তিনি বলেন, ‘ভবন নির্মাণ সরেজমিনে তদারকির লোকবলও দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে যে বিল্ডিং কোড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, তা খুবই সীমিত পরিসরে হচ্ছে। এভাবে বাড়িঘর তৈরি হতে থাকে, মানসম্মত ভবন তৈরি হয় না। কিন্তু নিয়ম হলো, মান ঠিক রাখা। সেটা হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে মিস্ত্রি বা প্রকৌশলী করছে হয়তো। কিন্তু করতে হবে নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞদের। এসব না করায় সাভার একটা ঝুঁকিপূর্ণ নগরে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে যেকেনো দুর্যোগে এই ভবনগুলোতে নানা রকম অসুবিধা তৈরি হবে। ভবন ধস হতে পারে, ভেঙে যেতে পারে। এমনকি নগরে বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে না। এতে স্থানীয় পর্যায়ে জনস্বাস্থ্যে ঝুঁকি তৈরি হয়। আলো বাতাস ঢুকে না, কলাম বিম ঠিকঠাক থাকে না। রাজউক বা সাভার পৌরসভার তদারকি ছাড়া ভবন নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে।’

‘ঝুঁকি এড়াতে পৌরসভা, প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদদের দায়িত্ব দিতে হবে। ইমরাত পরিদর্শক নিয়োগ করতে হবে স্থানীয় পর্যায়ে পরিদর্শনের জন্য। এটা নিশ্চিত না করা গেলে ঝুঁকি থেকেই যাবে।’

অন্যদিকে, সাভার পৌরসভা সাততলা পর্যন্ত ভবনের অনুমোদন দিলেও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে নির্মাণের সময় তদারকি করতে পারে না। ফলে ভবনটি আসলে কয় তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে, সে তথ্য জানা যায় না। 

সাভার পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা সাততলা পর্যন্ত অনুমোদন দেই। তবে অনুমোদনহীন কত ভবন রয়েছে, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। কতগুলো রয়েছে সেই তথ্য আছে। আমাদের পর্যাপ্ত জনবলের অভাব রয়েছে। আর সাভার পৌরসভা বহু আগে তৈরি হয়েছে। তখন থেকে তথ্য থাকলে সেটি হালনাগাদ করা যেতো। কিন্তু কখনো করা হয়নি।’

আরও পড়ুন : রানা প্লাজা ট্রাজেডি: বাঁচার লড়াই করছেন আহতরা, বিচার ও পুনর্বাসন দাবি

তিনি বলেন, ‘এত বড় একটা জায়গা। পৌরসভার রুটিন কাজ যারা করে, তাদের দিয়ে এ তথ্য তৈরি করা সম্ভব নয়। একটা জরিপ করলে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু অতীতে করা হয়নি। তবে অনুমোদনহীন ভবনের ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ পেলে চেষ্টা করি, সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের। কিন্তু স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু করি না।’

এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা রয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কার্যক্রমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া আসলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বিষয়। সিদ্ধান্ত হলে হয়তো করা যাবে। তবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে ডেটাবেজ কেন হয়নি, বা করা হবে কি না- এমন কিছু বলা সম্ভব নয়। আর এ এলাকা রাজউকের ড্যাপের আওতায় রয়েছে। ফলে কে কার অনুমোদন নিয়ে ভবন করল, সেটাও যাচাইয়ের বিষয় রয়ে যায়।’

এমজে

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর