রাতে কাজ, দিনে পড়াশোনা; যেভাবে জন্মাল বিন্তির লাখ টাকার ব্র্যান্ড

অনিন্দ্য শোভা
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৮

ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা জান্নাতুল ফেরদৌস বিন্তি—চঞ্চল, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি একটি মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই সবার আদরের, পরিবারের একমাত্র কন্যা। বাবা দেশের বাইরে, মা আর বড় ভাইয়ের স্নেহে মিরপুরেই বেড়ে ওঠা তার। আজ সেই মেয়েটি পরিচিত একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। তার হাতে তৈরি হয়েছে একটি ব্র্যান্ড—পিক ফ্রম মল্লিক।
সময়টা ২০২০ সাল। সদ্য শেষ হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। চারদিকে ডিজিটাল রূপান্তরের ঢেউ, অনলাইন ব্যবসার প্রসার। হঠাৎ তার মাথায় আসে এক ভাবনা— ‘যুগ বদলাচ্ছে, মানুষ অনলাইনে কেনাকাটায় আগ্রহী হচ্ছে। অথেনটিক আর কোয়ালিটি পণ্য নিয়ে কাজ করলে ভালো কিছু করা সম্ভব।’
তার পরিবার বরাবরই ছিল চা-প্রেমী। ছোটবেলা থেকেই ঘরে নানা ব্র্যান্ড ও উৎসের চা চেখেছেন। ভালো-মন্দের পার্থক্য জানতেন বলেই, ভাবলেন—নিজের প্রিয় জিনিস ‘চা’ দিয়েই শুরু হোক তার উদ্যোক্তা জীবন।
‘আমি নিজে যেভাবে কোয়ালিটিফুল চা পাতা ব্যবহার করি, ভাবলাম অন্যরাও যেন সেই স্বাদ পায়,’ বলেন তিনি। এই ভাবনা থেকেই শুরু পিক ফ্রম মল্লিক-এর যাত্রা।
২০২৪ সালের মার্চে, মিরপুর থেকে শুরু হয় পিক ফ্রম মল্লিক। মাত্র দশ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে শুরু করা এই উদ্যোগ এখন লাখ টাকার বিক্রিতে পৌঁছেছে।
তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছি। কঠোর মনোবল আর মায়ের সহযোগিতা আমাকে সাহস দিয়েছে।’ শুরুর উদ্দেশ্য ছিল অথেনটিক ও কোয়ালিটি চা পাতা সবার হাতে পৌঁছে দেওয়া। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক পণ্য—স্থানীয় তাঁতের বোনা কাপড় থেকে শুরু করে নানা ফুড আইটেম পর্যন্ত।
পিক ফ্রম মল্লিক-এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর আবেগের গল্প। তার নানী ছিলেন অতি চা-প্রেমী একজন মানুষ। নানীর কাছ থেকেই চায়ের প্রতি ভালোবাসা পান এই উদ্যোক্তা।
‘২০২০ সালে নানী মারা যান। আমি চা নিয়ে কাজ করি যেন তাকে আমার হৃদয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারি,’ বললেন তিনি।
‘পিক ফ্রম মল্লিক’-এর সিগনেচার পণ্য চা পাতা ও গ্রিন টি। এছাড়াও রয়েছে মনিপুরী উপজাতিদের হাতে তৈরি গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি, শাল।
ফুড আইটেমের মধ্যে রয়েছে সসেজ, চিজ, রামেন, আলফ্রেডো, বিভিন্ন সস, এবং ফ্রোজেন ফুড—চিকেন রোল, ভেজিটেবল রোল, চপ, চিকেন বল, চিজ বল, নাগেটস ইত্যাদি। তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য শুধু বিক্রি নয়—মানুষকে অথেনটিসিটি ও দেশীয় পণ্যের ওপর আস্থা ফিরিয়ে দেওয়া।’
পরিবার ও বন্ধুমহলের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন তিনি। তবে সামাজিক মানসিকতার বাঁধা আসেনি, এমন নয়। ‘শুরুর দিকে এলাকার মানুষ নানা কথা বলত। মানসিকভাবে ভেঙে পড়তাম, কিন্তু হাল ছাড়িনি,’ যোগ করেন তিনি।
বর্তমানে তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশে একাউন্টিং বিভাগে বিবিএতে অধ্যয়নরত। পড়াশোনা ও ব্যবসা—দুই-ই চালিয়ে যাচ্ছেন সমান্তরালে।
তিনি বলেন, ‘রাতে পেজের কাজ করি, ডেলিভারি শেষ করে গুছিয়ে রাখি। সেমিস্টার ব্রেকে শ্রীমঙ্গলে গিয়ে চা পাতা সোর্স করি, মনিপুরে গিয়ে কাপড় সংগ্রহ করি।’
এই অনবরত পরিশ্রমই তাকে আজকের অবস্থানে এনে দিয়েছেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন পিক ফ্রম মল্লিক শুধু অনলাইন ব্র্যান্ড না থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ শপে রূপ নেবে।
‘একটা দোকান করতে চাই, যেখানে ফুড আইটেম আর ক্লোথিং জোন আলাদা থাকবে। মানুষ হাতে-কলমে আমাদের পণ্যের মান অনুভব করতে পারবে,’ বললেন তিনি।
আইএইচ/