Logo

জাতীয়

বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় : কী, কেন, কীভাবে কাজ করবে?

Icon

বাংলাদেশের প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৫, ২০:১৬

বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় : কী, কেন, কীভাবে কাজ করবে?

জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) সদরদপ্তর। ছবি : গ্লোবাল সাউথ অপারচুনিটিজ থেকে নেওয়া

বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় চালু হতে যাচ্ছে। তিন বছর মেয়াদি মিশন চালুর জন্য সমঝোতা স্মারক সই করেছে দুই পক্ষ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্রসচিব আসাদ আলম সিয়াম এবং জাতিসংঘের পক্ষে সংস্থাটির মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছেন।

শুক্রবার (১৮ জুলাই) জেনেভা থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। 

জাতিসংঘের মানবাধিকার মিশন আসলে কী?

ওএইচসিএইচআর হলো জাতিসংঘের একটি প্রধান সংস্থা। এই সংস্থা বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে। এটি ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। জেনেভায় এর প্রধান কার্যালয় অবস্থিত। ওএইচসিএইচআরের ম্যান্ডেট পাওয়া জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) সদস্যরা বিভিন্ন দেশে পর্যবেক্ষণ, সহায়তা ও পরামর্শমূলক মিশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এসব মিশনের মাধ্যমে মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়ন, ক্ষমতায়নের উদ্যোগ, আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কারে সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো হয়।

বাংলাদেশে কার্যালয় খোলার কারণ কী?

গত এক দশকে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশি-বিদেশি বহু সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাসসহ নানা ইস্যুতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের পর্যবেক্ষণ ছিল তীব্র।

বিশেষ করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচন এবং বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়নের অভিযোগ ঘিরে জাতিসংঘ বাংলাদেশে একটি পর্যবেক্ষণমূলক উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ফলে আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, একটি সহযোগিতামূলক মানবাধিকার কার্যালয় খোলা হবে। যে কার্যালয় নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সরকারের সঙ্গে কাজ করবে।

গত বছরের আগস্ট থেকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ বৃদ্ধি পায়। গত বছরের জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সহিংস দমন-পীড়ন নিয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান চালিয়ে ইতোমধ্যে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে জাতিসংঘ। আর গত ১০ জুলাই ঢাকায় তিন বছরের জন্য মানবাধিকার মিশন স্থাপনের জন্য সমঝোতা স্মারকের খসড়া অনুমোদন করে উপদেষ্টা পরিষদ।

এই মিশন কীভাবে কাজ করবে?

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওএইচসিএইচআর বলছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক এই কার্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে মূলত বাংলাদেশে মানবাধিকারের ‘উন্নয়ন ও সুরক্ষার’ বিষয়কে সমর্থন দিতে। এই কার্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে জাতিসংঘ। একইসঙ্গে, মানবাধিকার বিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার ও নাগরিক সমাজের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করবে।

ওএইচসিএইচআরের বাংলাদেশ কার্যালয় মূলত তিনটি ক্ষেত্রে কাজ করবে-

১. পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা : মানবাধিকার সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালা সংস্কারে সরকারকে পরামর্শ দেবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের মানবাধিকার সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দেবে।

২. পর্যবেক্ষণ ও রিপোর্টিং : দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে এবং তা জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থায় উপস্থাপন করা হবে।

৩. সচেতনতা ও অংশীদারিত্ব : এনজিও, সিভিল সোসাইটি ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করে মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো হবে। পাশাপাশি তরুণদের মানবাধিকার বিষয়ে শিক্ষিত ও সক্রিয় করে তোলা হবে।

তবে এই মিশনের কোনো আইন প্রয়োগকারী ক্ষমতা থাকবে না। এটি সুপারিশ ও সংলাপের মাধ্যমে পরিবর্তনের চেষ্টা চালাবে।

অন্য কোন কোন দেশে আছে এমন কার্যালয়?

ওএইচসিএইচআরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের তথ্যমোতাবেক, বর্তমানে ৮০টিরও বেশি দেশে ওএইচসিএইচআরের প্রায় ৯০টি মাঠপর্যায়ের অফিস রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, কলম্বিয়া, সুদান, কিরগিজস্তান, সোমালিয়া, ফিলিপাইন, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, দক্ষিণ সুদান, ইউক্রেন ও সিরিয়ার মতো দেশ। এসব কার্যালয় সংশ্লিষ্ট দেশে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ ও সহায়তার কাজ করে।

বাংলাদেশে কার্যালয় মানে কি হস্তক্ষেপ?

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এই কার্যালয় কোনো ‘হস্তক্ষেপমূলক’ সংস্থা নয়। এটি সরকারের অনুমোদিত একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। সব কাজ সরকার ও জাতিসংঘের সম্মতিতে পরিচালিত হবে।

তবে সমালোচকরা মনে করেন, এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি একটি নজরদারিরমূলক বার্তা হতে পারে। বিশেষ করে ২০২৬ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্যপদ বজায় রাখা, জিএসপি সুবিধা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সুরক্ষার দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ।

উদ্বেগ জানিয়েছে যারা

বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় স্থাপনের জন্য গত ১০ জুলাই উপদেষ্টা পরিষদ সমঝোতা স্মারকের খসড়া অনুমোদন করে। সে সময় সরকারের এই উদ্যোগে ‘গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা’ প্রকাশ করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। দলটি ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশে তারা জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় খুলতে দেবে না। 

এর আগে গত ৫ জুলাই এ সংগঠনের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘মানবাধিকারের’ নামে ইসলামি শরিয়াহ, পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় মূল্যবোধে ‘হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা’ করেছে। এসব হস্তক্ষেপ একদিকে যেমন জাতীয় সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত, অন্যদিকে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অনুভূতিরও পরিপন্থি। তাই বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় খুলতে দেওয়া হবে না। 

এ ছাড়া ঢাকায় জাতিসংঘের মিশন অনুমোদনের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির ভাষ্য, এই কার্যালয় স্থাপনের কোনো ইতিবাচক দিক নেই। কার্যালয় খোলার অনুমতি দেওয়া দেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে বিপদ ডেকে আনবে।

এইচকে/

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

জাতিসংঘ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর