ঢাবির লিফট যেন ‘মরণফাঁদ’, আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৫, ১৩:৫৯

ঢাবিতে প্রায়ই লিফট আটকে যাওয়ার ঘটনা ঘটে /ছবি : বাংলাদেশের খবর
দেশসেরা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের ভয় আর আতঙ্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। ঢাবিতে নয়া আতঙ্কের নাম লিফট দুর্ঘটনা। ঢাবির কয়েকটি হল ও ভবনে লিফট দুর্ঘটনা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। লিফট দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যুও হয়েছে। কিন্তু টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের।
জানা গেছে, গেল ২৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র (কারস) ভবনে লিফট দুর্ঘটনায় মোহাম্মদ আবদুল্লাহ নামের এক কর্মকর্তার মৃত্যু হয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক (হিসাব) পদে কর্মরত ছিলেন।
দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে ও প্রতিকারের বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটিতে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন উপমা কবির, সহকারী প্রক্টর আবু আছাদ চৌধুরী, কারসের পরিচালকের একজন প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. আকরাম হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (তদন্ত) শেখ আইয়ুব আলী। কিন্তু ওই কমিটির অনেকেই সে বিষয়ে কিছু জানেন না বলে অভিযোগ ঢাবি শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, লিফট দুর্ঘটনায় মারা গেলেও টনক নড়েনি প্রশাসনের। একের পর এক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে বিভিন্ন হল ও অনুষদের শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি কলাভবনের ছয় তলা থেকে নামতে গিয়ে ৩০ মিনিট আটকা পড়ে পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের ২৬ শিক্ষার্থী। লিফটে আটকে থাকায় এক নারী শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে ঢাবি মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাবির সূর্য সেন হলের দক্ষিণ দিকের লিফট ব্যবহার করতে গিয়ে বেলাল সরকার নামের এক শিক্ষার্থী অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার শিকার হয়। লিফটের দরজা শরীরে লাগতেই তিনি বিদ্যুতায়িত (শক) হন। পরে কিছু দিনের জন্য লিফটটি বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া, বিজয় একাত্তর হলের পদ্মা ব্লকের লিফটে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ২০-২৫ মিনিট ধরে আটকা ছিলেন বলে জানান ওই হলের এক শিক্ষার্থী। আর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের লিফট কয়েকদিন পরপর নষ্ট হয়ে যায়। ওই হলের অনেক শিক্ষার্থী লিফটে আটকা পড়া নিয়ে অভিযোগ করেছেন।
কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে লিফট ৭-৮ তলার মাঝামাঝি স্থানে আটকে যায়। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে লিফট দুটি ফ্লোরের মাঝামাঝি স্থানে থেমে যায়। হল কর্তৃপক্ষ লিফটটি কোনো এক ফ্লোরে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পরে শিক্ষার্থীরা আতঙ্ক নিয়ে বের হন।
শিক্ষার্থীরা জানান, সূর্য সেন হলে একটি ,বিজয় একাত্তর হলের পদ্মা ও যমুনা ব্লকের দুটি, কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রত্যয় বিল্ডিংয়ের একটি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের একটি, রোকেয়া হলের প্রধান বিল্ডিংয়ের একটি, হাজী মোহাম্মদ মুহসিন হলের দুটি, জগন্নাথ হলের সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনের চারটি, সায়েন্স কমপ্লেক্স ভবনের একটি, কলাভবনের দুটিসহ মোট ১৫টি লিফট যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে চলছে।
কবি সুফিয়া কামাল হলের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তৃপ্তি পাল বলেন, সকালে ক্লাসে যাওয়ার সময় প্রদীপ্ত বিল্ডিংয়ের ১০ তলা থেকে লিফটে উঠি। কিন্তু নিচতলায় গিয়ে লিফট বন্ধ হয়ে যায়। অনেক ধাক্কাধাক্কির পরেও কেউ সাড়া দেয়নি। ভাগ্যিস নেটওয়ার্ক কাজ করছিল- তাই লিফটে থাকা নম্বরে কল দিয়ে একজনকে পাই। কিন্তু যদি আজকে নেটওয়ার্ক না থাকতো তাহলে কি হতো, কেউ তো আমাকে সাহায্য করার জন্য আসতো না।
তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করছি, লিফটের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে সমাধান করার জন্য। বারবার এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন যেন আমাদের হতে না হয়।
মুহসিন হলের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান রাফি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিড়ম্বনার মধ্যে অন্যতম লিফট। কলাভবনের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যবহার উপযোগী দুটি লিফটের মধ্যে দুটিই সমস্যায় জর্জরিত। কিছু দিন পরপর লিফট আটকে যাওয়া, দোতলা থেকে লিফট ছিঁড়ে পড়া ইত্যাদি ভোগান্তি এখন নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি জায়গা হবে উন্নত ও শিক্ষার্থীবান্ধব অথচ আমরা দেখি এর বিপরীত চিত্র।
তিনি বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের এসব লিফট দিয়ে উঠানামা করতে হয়। একই অবস্থা হলের লিফটগুলোতে। মুহসীন হলের লিফটের ভয়ংকর বেহাল দশা, জরাজীর্ণ ও ভাঙাচোরা। প্রশাসনকে দফায় দফায় বিষয়গুলো জানালেও এই সমস্যার কোনো সমাধান নাই। ওনারা বিষয়টা দেখেও না দেখার ভান করছেন।
কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সালমা নাসরিন বলেন, হলের লিফটের সমস্যা দেখা দিলে আমরা সাময়িক সময়ের জন্য লিফট বন্ধের নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছি। দ্রুত সমাধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত দিয়েছি।
কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, কলাভবনের মাঝখানের লিফটের মেরামতের কাজ চলমান। প্রক্টর অফিসের পাশের লিফটে কখনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী লিফটে উঠায় এমন ঘটনা ঘটছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কলা অনুষদের মাঝখানের লিফট চালু হবে বলে আশা করছি। লিফটে উঠা-নামার ক্ষেত্রে আমাদেরকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে।
ঢাবির প্রধান প্রকৌশলী আক্রাম হোসেন বলেন, গত ২৫ অক্টোবর লিফট দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া কর্মকর্তার তদন্ত প্রতিবেদন সাবমিট করেছি অনেক আগে। পরবর্তীতে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানি না।
তিনি বলেন, কলাভবনে সম্প্রতি লিফট দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। ওভার লোডের কারণে এমন হয়েছে। প্রায় আধা ঘণ্টা শিক্ষার্থীরা লিফটে আটকা ছিলেন। যতটুকু শুনেছি, লিফটম্যান সেখানে ছিলেন না। দায়িত্বে অবহেলার কারণে লিফট থেকে শিক্ষার্থীদের বের করতে দেরি হয়েছে।
আক্রাম হোসেন বলেন, লিফটের একটি নির্দিষ্ট ধারণ ক্ষমতা আছে। ধারণক্ষমতার বেশি হলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এমএমআই/ওএফ