Logo

বিশেষ সংবাদ

দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতি

পিআর বনাম এফপিটিপি

মো. বাবুল আক্তার

মো. বাবুল আক্তার

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ১২:২৯

দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতি

গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাসের মাথায় এখন সবচেয়ে বড় বিতর্ক, নির্বাচন পদ্ধতির কাঠামো কেমন হবে? সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে 'দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ' এবং পিআর পদ্ধতি চালুর সুপারিশে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভক্তি আরও স্পষ্ট হয়েছে। একপক্ষ সরাসরি ভোট চায়, অন্যপক্ষ চায় প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর)। এই দ্বন্দ্বের পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক কৌশল, গাণিতিক বাস্তবতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের খেলা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে ছোট দলের উত্থান ও বহুত্ববাদের সুযোগ থাকলেও রয়েছে অস্থিরতাসহ সরকার ও দলীয় নিয়ন্ত্রণ বাড়ার ঝুঁকি। সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উচ্চকক্ষে 'আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব' পদ্ধতি প্রবর্তনের সুপারিশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে ব্যাপক আলোড়ন ও স্পষ্ট বিভাজন। দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি ও তার মিত্ররা প্রচলিত 'ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট' (এফপিটিপি) বা সরাসরি ভোটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু ইসলামপন্থি ও বাম দল পিআর পদ্ধতির জন্য জোর দাবি জানাচ্ছে। এই বিতর্কের গভীরে নিহিত রয়েছে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির জটিল হিসাব, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার প্রশ্ন।

পিআর পদ্ধতি আসলে কী:
বাংলাদেশে সংসদ সদস্য নির্বাচনের যে পদ্ধতি চালু আছে, তা হলো 'ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট' (এফপিটিপি)। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি সংসদীয় আসনে যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পান, তিনিই বিজয়ী হন, যদিও তিনি মোট ভোটের অর্ধেকেরও কম পান। পরাজিত প্রার্থীদের সব ভোট মূল্যহীন হয়ে যায় এর বিপরীতে, 'আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব' বা পিআর একটি ভিন্নধর্মী ব্যবস্থা।

এখানে ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয়, বরং রাজনৈতিক দলকে তাদের পছন্দের প্রতীক দেখে ভোট দেন। সারা দেশে একটি দল যে পরিমাণ বা শতাংশ ভোট পায়, সেই অনুপাতে সংসদে আসন লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ, ৩০০ আসনের সংসদে কোনো দল যদি ১০ শতাংশ ভোট পায়, তবে তারা ৩০টি আসন পাবে। বিশ্বের প্রায় ৯১টি দেশে এই পদ্ধতি বা এর মিশ্র রূপ প্রচলিত আছে, যার মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী নেপাল ও শ্রীলঙ্কাও রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংবিধান সংস্কার কমিশন ৪০০ আসনের নিম্নকক্ষ (বিদ্যমান এফপিটিপি পদ্ধতিতে) এবং ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ (পিআর পদ্ধতিতে) গঠনের সুপারিশ করলে এই বিতর্ক নতুন মাত্রা পায়। উদ্দেশ্য হলো, সংসদে সব মতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা এবং একক দলের একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটানো।

পিআর পদ্ধতির পক্ষে যত যুক্তি: 
পিআর পদ্ধতির সমর্থকরা, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ছোট দলগুলো, বেশ কিছু শক্তিশালী যুক্তি তুলে ধরছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, এফপিটিপি পদ্ধতিতে একজন প্রার্থী ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলে তিনি ওই আসনের শতভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্বের দাবি করেন। বাকি ৬৫ শতাংশ ভোটারের মতামত সেখানে প্রতিফলিত হয় না। পিআর পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকে এবং প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হওয়ায় এটিকে অধিকতর গণতান্ত্রিক বলে মনে করা হয়।

নির্বাচন বিশ্লেষক তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, পিআর পদ্ধতি চালু হলে সংসদে একক দলের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটবে। ধরা যাক, ১ শতাংশ ভোট পেলেই যদি কোনো দল আসন পাওয়ার যোগ্য হয়, তবে অনেক ছোট দলও সংসদে তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে। এতে একটি 'প্লুরাল' বা বহুত্ববাদী সংসদ গঠিত হবে, যেখানে বিভিন্ন মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটবে।

সমর্থকদের যুক্তি, এফপিটিপি পদ্ধতিতে সামান্য ভোটের ব্যবধানেও আসনের সংখ্যায় বিশাল পার্থক্য তৈরি হয়, যা অনেক সময় কৃত্রিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করে এবং বিরোধী দলকে প্রান্তিক করে ফেলে। পিআর পদ্ধতিতে ভোটের হারের কাছাকাছি আসন বণ্টন হওয়ায় সংসদে একটি ভারসাম্য তৈরি হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক সংঘাত কমাতে সহায়ক হতে পারে। যেহেতু প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের চেয়ে দলের ভোট বাড়ানোই মূল লক্ষ্য থাকে, তাই আসনভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার, কেন্দ্র দখল বা ব্যক্তিগত সংঘাতের প্রবণতা কমে আসবে বলে আশা করা হয়।

সম্ভাবনা ও ঝুঁকির সমীকরণ, বিপক্ষের উদ্বেগ:
পিআর পদ্ধতির সম্ভাবনার পাশাপাশি এর কিছু গুরুতর ঝুঁকি ও অসুবিধাও রয়েছে, যা বিএনপি এবং এর সমর্থকদের উদ্বেগের মূল কারণ।

১. পিআর পদ্ধতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, এখানে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দল থেকে কারা সংসদ সদস্য হবেন, তার একটি তালিকা নির্বাচনের আগেই বা পরে তৈরি করা হয়। ভোটাররা কেবল দলকে ভোট দেন, প্রার্থী বাছাইয়ে তাদের কোনো ভূমিকা থাকে না। তোফায়েল আহমেদের ভাষায়, 'তখন পার্টি তার ইচ্ছেমতো প্রার্থী দিয়ে দিতে পারবে... স্বামী-স্ত্রী-আত্মীয়স্বজনকে মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।' এটি দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে সংকুচিত করতে পারে।

২. এফপিটিপি পদ্ধতিতে একজন সংসদ সদস্য তার নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে শুরু করে স্থানীয় সমস্যা সমাধানে তার ভূমিকা থাকে। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হলে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার প্রতি তার দায়বদ্ধতা থাকে না বললেই চলে। এতে জনগণ ও প্রতিনিধির মধ্যে একটি দূরত্ব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

৩. পিআর পদ্ধতির একটি সাধারণ পরিণতি হলো 'ঝুলন্ত সংসদ', যেখানে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না। সরকার গঠনের জন্য একাধিক দলকে নিয়ে জোট গঠন করতে হয়। এই জোট সরকারগুলো প্রায়শই দর-কষাকষির ওপর নির্ভরশীল এবং বিভিন্ন দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অস্থির হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। এটি ঘন ঘন সরকার পতনের কারণ হতে পারে, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর।

৪. বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য পিআর পদ্ধতির হিসাব বেশ জটিল। হুট করে এই পদ্ধতি চালু করলে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, যা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মিরপুরের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মালেক হোসেনের মতো অনেকেই।

দলগুলোর ভিন্ন সুর, নেপথ্যের সমীকরণ: 
পিআর পদ্ধতি নিয়ে প্রধান দলগুলোর ভিন্ন অবস্থানের পেছনে রয়েছে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। বিএনপি মনে করে, এই পদ্ধতির আড়ালে পরাজিত শক্তিকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা চলছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই পদ্ধতিকে 'বিভক্তিমূলক' আখ্যা দিয়েছেন। এর পেছনের অংকটি পরিষ্কার। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪১% ভোট পেয়ে ১৯৩টি আসন জিতেছিল। পিআর পদ্ধতি থাকলে তারা পেত প্রায় ১২৩টি আসন। আবার ২০০৮ সালে ৩২% ভোট পেয়ে মাত্র ৩০টি আসন পেলেও পিআর পদ্ধতিতে তাদের আসন সংখ্যা হতো ৯৬টি। অর্থাৎ, যখন দলটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখে, তখন এফপিটিপি তাদের জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে কোণঠাসা অবস্থায় পিআর তাদের জন্য রক্ষাকবচ হতে পারে। তবে সার্বিকভাবে, একক বা বৃহৎ দল হিসেবে সরকার গঠনের জন্য এফপিটিপিকেই তারা শ্রেয় মনে করে।

জামায়াতে ইসলামীসহ ছোট দলগুলোর জন্য পিআর পদ্ধতি অনেকটা সঞ্জীবনী সুধার মতো। ১৯৯১ সালে জামায়াত তাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১২% ভোট পেয়ে আসন পেয়েছিল মাত্র ১৮টি। যদি তখন পিআর পদ্ধতি থাকত, তাহলে তাদের আসন সংখ্যা হতো ৩৬টি, অর্থাৎ দ্বিগুণ। এই কারণেই জামায়াতসহ অন্য ছোট দলগুলো মনে করে, এফপিটিপি পদ্ধতির কারণে তাদের জনসমর্থনের সঠিক প্রতিফলন সংসদে ঘটে না। পিআর তাদের জন্য সংসদে শক্তিশালী অবস্থান তৈরির একমাত্র পথ।

সাধারণ মানুষ কী ভাবছে: 
এই পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে যখন রাজনৈতিক বিতর্কের ঝড় বইছে, তখন সাধারণ মানুষের ভাবনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত। ঢাকার রিকশাচালক রইস মিয়া বা স্টেশনারি দোকানি আব্দুস সালামের মতো অনেকের কাছে পিআর বা এফপিটিপি কোনো জটিল বিষয় নয়। তাদের মূল চাওয়া হলো একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, যেখানে তারা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। বেসরকারি কর্মকর্তা জলিল হোসেনের মতো কেউ কেউ সংস্কারের পক্ষে হলেও এর প্রায়োগিক দিক নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, 'উন্নত দেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, সেটি আমাদের দেশে হলে তো ভালোই হবে। কিন্তু ভালো করতে গিয়ে খারাপ হলে আবার সমস্যা।' বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তামিম হোসেনের মতো তরুণ প্রজন্ম চায় একটি টেকসই সংস্কার, যা ভবিষ্যৎ স্বৈরাচারের পথ রুদ্ধ করবে। তবে অধিকাংশের মধ্যেই একটি সাধারণ আশঙ্কা কাজ করছে- এই পদ্ধতিগত বিতর্ককে ইস্যু বানিয়ে নির্বাচন যেন পিছিয়ে না দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। পিআর পদ্ধতি একদিকে যেমন গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল করার সম্ভাবনা তৈরি করে, তেমনই অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দলীয় স্বৈরতন্ত্রের ঝুঁকিও বাড়ায়। বিশ্লেষকদের একাংশ তাই একটি মিশ্র পদ্ধতির কথা বলছেন। যেমন- নিম্নকক্ষের নির্বাচন এফপিটিপি পদ্ধতিতে এবং উচ্চকক্ষ বা সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করা। এতে নতুন পদ্ধতিটির একটি পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হতে পারে এবং এর কার্যকারিতা যাচাইয়ের সুযোগ পাওয়া যাবে।

দিনশেষে, যে কোনো নির্বাচন পদ্ধতির চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করে এর স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রয়োগের ওপর। রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধুমাত্র নিজেদের লাভ-ক্ষতির হিসাবের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার কথা ভাবতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও সংবিধান সংস্কার কমিশনকে এমন একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে, যা সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জনগণকে একটি বিতর্কমুক্ত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেবে।

এমবি 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর