Logo

বিশেষ সংবাদ

সুশাসন ফেরানো চ্যালেঞ্জ

এম এ বাবর

এম এ বাবর

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ১১:০৭

সুশাসন ফেরানো চ্যালেঞ্জ

গভীর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক সংকটের মুখোমুখি দেশ। এক বছর আগে যে 'জুলাই বিপ্লব' একটি নতুন, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, আজ সেই স্বপ্ন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অসহযোগিতার কারণে নতুন এক সূর্যোদয়ের বদলে আমরা এক নতুন রকমের নৈরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। আর ত্রিপক্ষীয় টানাপোড়েনে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। 

স্বৈরাচারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পেরিয়ে গেলেও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। এই রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, গণপিটুনি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, রাষ্ট্রের ভিত্তিই আজ হুমকির মুখে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না, যা বাংলাদেশকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সব সংকটের উৎস :
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের প্রধান শর্ত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু বিপ্লবের এক বছর পরও সেই নির্বাচন আয়োজনের কোনো রোডম্যাপ তৈরি না হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গভীর অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'নির্বাচন না হওয়ার কারণেই আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে, মৃত্যু বাড়ছে।' তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাদের মতে, নির্বাচিত সরকার না থাকায় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব ও শক্তি প্রদর্শনের জন্য রাজপথের সহিংসতাকে বেছে নিচ্ছে। এর ফলে তৈরি হচ্ছে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, যা সরাসরি চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের জন্ম দিচ্ছে।

মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড, যেখানে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নাম এসেছে, তা প্রমাণ করে যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো সংস্কারের পথে না হেঁটে পুরোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। অন্যদিকে, 'জুলাই বিপ্লব' থেকে উঠে আসা নতুন রাজনৈতিক শক্তি, যেমন জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং ছাত্র আন্দোলনগুলোও একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামোর অভাবে তাদের কার্যক্রমকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে পারছে না। এই ত্রিপক্ষীয় টানাপোড়েনে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ :
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে যেমন জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা, অন্যদিকে একটি ভেঙে পড়া প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পুনর্গঠনের কঠিন দায়িত্ব। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা যে করছে না, তা নয়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে দেশজুড়ে 'চিরুনি অভিযান' দ্রুত শুরু হচ্ছে। পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা। সরকারি তথ্যমতে, সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত ৭০০-এর বেশি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং প্রায় ছয় হাজার অবৈধ অস্ত্র ও দুই লাখ গুলি উদ্ধার করেছে। এটি একদিকে যেমন সরকারের সংকল্পের পরিচয় দেয়, তেমনই বেসামরিক প্রশাসনের চরম ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

প্রশাসনের ভিতরেও সংকট গভীর। পুলিশের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাবের পুরোনো সংস্কৃতি এখনো বিদ্যমান। দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাহিনীর মধ্যে কোনো জবাবদিহিতা তৈরি হচ্ছে না।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। 'জুলাই বিপ্লব' ছিল একটি আশা, কিন্তু সেই আশার বাস্তবায়ন যদি হয় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভিতরে- তবে তা আর বিপ্লব নয়, বরং একটি স্বপ্নভঙ্গ। তবু এখনো সময় আছে। যদি সব পক্ষ মিলে, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে জাতিকে সামনে নিয়ে যেতে চায়- তবে হয়তো সেই স্বপ্ন আবারও সত্যি হতে পারে। নইলে আইন, নৈতিকতা ও সহানুভূতির পতনের সঙ্গে সঙ্গে জাতি হারাবে তার ভবিষ্যৎ। তা ছাড়া, একটি অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পতনের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণে নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনকে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, অপরাধ ও রাজনীতি এখন একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণদের পদত্যাগ ও বিবৃতি দেখাচ্ছে, তারা মূল্যবোধনির্ভর রাজনীতির দিকে যেতে চায়। তবে রাজনীতির পচনশীল ব্যবস্থায় সংস্কারের সুযোগ কতটুকু? ছোট অস্ত্রের বিস্তার এবং রাজনৈতিক ক্যাডারদের আধিপত্য বিস্তার দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি :
বর্তমানে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে এক কথায় 'ভেঙে পড়েছে' বলা যায়। অপরাধের ধরন ও মাত্রা এতটাই ব্যাপক যে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গণপিটুনি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিস্তর। আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা কতটা তলানিতে পৌঁছেছে, তার ভয়াবহ উদাহরণ হলো গণপিটুনির মহামারি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত তিন মাসে দেশজুড়ে ৬৮ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। চোর, ডাকাত বা অপহরণকারী সন্দেহে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই প্রবণতা প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষ পুলিশ বা আদালতের ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে।

এদিকে লাগামহীন সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি দেশে মহামারি আকারে ধারণ করেছে। মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড চাঁদাবাজির সমস্যার একটি খণ্ডচিত্র মাত্র। রাজধানীসহ সারা দেশেই মার্কেট, পরিবহন এবং নির্মাণ খাতে 'প্রোটেকশন মানি'র নামে নীরব সন্ত্রাস চলছে। চালককে হত্যা করে ইজিবাইক ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা প্রান্তিক পর্যায়েও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে নারী ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগও কম নয়। সামাজিক অস্থিরতার সুযোগে নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে। গত তিন মাসে ৭৮টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় নীরব। এ ছাড়া, হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর এবং সম্পত্তি দখলের ঘটনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিকেও নাড়িয়ে দিচ্ছে।

মনোবলহীন পুলিশ বাহিনী :
গণঅভ্যুত্থানের সময় ৪২ জন পুলিশ সদস্যের নিহত হওয়া এবং জনগণের রোষের শিকার হওয়ায় পুলিশ বাহিনী এখনো তাদের মনোবল ফিরে পায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, "আন্দোলনের সময় পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং জনগণের ক্ষোভের ফলে বাহিনী এখনো আত্মবিশ্বাসী হতে পারছে না। সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে পড়েছে।" একই সুরে অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক মন্তব্য করে বলেন, পুলিশ প্রশাসন নৈতিক শক্তি হারিয়েছে। তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের ভাবনা :
এই বহুমাত্রিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি জরুরি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে এবং একটি বৈধ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা অপরিহার্য। একই সঙ্গে পুলিশের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে একটি স্বাধীন, পেশাদার এবং জবাবদিহিতামূলক বাহিনী হিসেবে পুনর্গঠন করতে হবে। নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডসহ সব চাঞ্চল্যকর মামলার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি করে বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফেরাতে হবে। আর সহিংসতা পরিহার করে একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। গণপিটুনি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক যেমনটা বলেছেন, আইন মানার প্রশ্নে বিভাজন তৈরি হলে সহিংসতা মনোভাবাপন্ন শ্রেণির মধ্যে স্পৃহা বাড়ে। এই বিভাজন দূর করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্বিকভাবে বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। 'জুলাই বিপ্লবের' মাধ্যমে অর্জিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আজ অনিয়ন্ত্রিত সহিংসতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিপন্ন। আইনশৃঙ্খলার এই চরম অবনতি শুধুমাত্র একটি নিরাপত্তা সংকট নয়, এটি দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য এক অশনিসংকেত। যদি সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং নাগরিক সমাজ একযোগে এই সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়, তবে দেশটি এক দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হতে পারে, যা থেকে ফিরে আসা হবে অত্যন্ত কঠিন। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এমবি 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর