ক্ষমতা বাড়ছে ইসির, কঠিন হচ্ছে প্রার্থীদের পথ
নির্বাচন ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন
প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২৫, ০৮:২০
-687da3f763c65.jpg)
সংবিধানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে বড় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাবনায় এবার ইসি, বিনাভোটে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচনের পথ পুরোপুরি বন্ধ করতে চায়। পাশাপাশি ইভিএম বাদ দেওয়া, সশস্ত্র বাহিনীকে সংজ্ঞায় আনা, নির্বাচনি অনিয়মে সম্পূর্ণ আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়াসহ নানা প্রস্তাব রয়েছে খসড়ায়।
ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় অনুষ্ঠিত, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতেই বিনাভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ এবং নির্বাচনি ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এর আমূল সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন।
প্রস্তাবিত এই সংশোধনীতে কেবল বিনাভোটের সুযোগ বন্ধ করাই নয়, বরং নির্বাচনে অনিয়ম রোধে কমিশনের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার, প্রার্থীদের যোগ্যতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ এবং জোটবদ্ধ নির্বাচনের পুরনো চর্চায় পরিবর্তন আনাসহ বেশ কিছু যুগান্তকারী বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই উদ্যোগকে নির্বাচনি বিশেষজ্ঞরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পথে একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
‘না’ ভোটের নতুন শক্তি :
প্রস্তাবিত আরপিও সংশোধনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিধানটি হলো- কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলেও তাকে আর বিজয়ী ঘোষণা করা হবে না। পরিবর্তে, তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে 'না' ভোটের সঙ্গে। ব্যালট পেপারে ওই প্রার্থীর প্রতীকের পাশাপাশি একটি 'না' ভোট প্রদানের সুযোগ থাকবে। নির্বাচনে যদি প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে 'না' ভোটের সংখ্যা বেশি হয়, তবে ওই আসনে নির্বাচন বাতিল বলে গণ্য হবে। নির্বাচন কমিশন তখন নতুন করে তফসিল ঘোষণা করে পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করবে।
এই বিধানটি কার্যকর হলে দেশের নির্বাচনি সংস্কৃতিতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অতীতে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনে, প্রধান বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের বহু প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, যা নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। নতুন এই নিয়মের ফলে কোনো দল নির্বাচন বর্জন করলেও একক প্রার্থীকে জনগণের মুখোমুখি হতেই হবে এবং জনগণের রায় (হ্যাঁ অথবা না) নিয়েই তাকে বিজয়ী হতে হবে।
এর আগে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন 'না' ভোটের বিধান চালু করলেও তা ছিল অনেকটাই শক্তিহীন। নির্বাচন বিশ্লেষক মো. আব্দুল আলীম যেমনটি বলেছেন, "২০০৮ সালের 'না' ভোট ছিল অর্থহীন, কারণ সেখানে 'না' ভোট জয়ী হলেও নির্বাচন বাতিলের কোনো বিধান ছিল না।" কিন্তু বর্তমান কমিশনের প্রস্তাব সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে 'না' ভোটকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক অস্ত্রে পরিণত করতে যাচ্ছে।
ইসির ক্ষমতা পুনরুদ্ধার :
নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে আরপিও সংশোধনীতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেলে যে কোনো পর্যায়ে পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ফিরে পাওয়া। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, 'পুরো আসনের নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা আগে ইসির ছিল, যা পরে বাতিল করা হয়েছিল। আমরা সেই ক্ষমতা ফেরত পাওয়ার প্রস্তাব করেছি এবং আশা করছি, সরকার এতে সম্মতি দেবে।'
এই ক্ষমতা ফিরে পেলে নির্বাচন পরিচালনায় ইসির কর্তৃত্ব বহুলাংশে বাড়বে। ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী মনে করেন, "ভোটের যে কোনো পর্যায়ে পুরো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা ইসির হাতে থাকলে তা কমিশনের ক্ষমতাকে আরও দৃশ্যমান করবে এবং অনিয়ম করতে চাওয়া ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিবৃত্ত করবে।"
এর পাশাপাশি, নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী কর্তব্যে অবহেলা করলে বা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করলে তার বিরুদ্ধে ইসির শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই শাস্তির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার চাকরির খতিয়ান বা সার্ভিস বুকে উল্লেখ থাকবে, যা তার কর্মজীবনের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। সম্প্রতি গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ইসির সুপারিশ সত্ত্বেও দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার উদাহরণ এই প্রস্তাবের যৌক্তিকতাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
প্রার্থী ও জোটের জন্য নতুন নিয়ম :
প্রার্থীদের খেয়ালখুশি মতো একাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগও সীমিত করা হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ তিনটি আসনে লড়তে পারলেও সংশোধিত প্রস্তাবে তা কমিয়ে দুটি করা হয়েছে। যদি কোনো প্রার্থী দুটির বেশি আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন, তবে তার সব মনোনয়নপত্রই বাতিল হয়ে যাবে। এই বিধানটি প্রার্থীদের নিজ নিজ আসনের প্রতি আরও মনোযোগী করবে এবং হেভিওয়েট প্রার্থীদের দ্বারা একাধিক আসন 'ব্লক' করে রাখার প্রবণতা কমাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, জোটবদ্ধ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আসছে বড় পরিবর্তন। বিগত নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, বড় দলের নেতৃত্বে গঠিত জোটের শরিক দলগুলো নিজেদের প্রতীকের পরিবর্তে জোটের প্রধান দলের প্রতীকে (যেমন: নৌকা বা ধানের শীষ) নির্বাচন করেছে। এতে অনেক নামসর্বস্ব দলের প্রার্থীরাও শুধু প্রতীকের জোরে বিজয়ী হয়েছেন, যা দল হিসেবে তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল করেছে। এই সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জোট করলেও প্রতিটি নিবন্ধিত দলকে নিজ নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। এতে ভোটাররা যেমন বিভ্রান্ত হবেন না, তেমনই প্রতিটি দলের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক শক্তি যাচাইয়ের সুযোগ তৈরি হবে।
আধুনিকায়ন ও স্বচ্ছতার পথে যাত্রা :
প্রযুক্তিগত দিক থেকে একটি বড় সিদ্ধান্ত হলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিধান আরপিও থেকে বাতিল করা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইভিএম নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ ও আস্থার সংকট থাকায় কমিশন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ স্পষ্টভাবেই বলেছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকায় আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সামনের কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না।
আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেও কঠোর বিধান আনা হচ্ছে। এখন থেকে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা একটি রাজনৈতিক দলকে এক অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা অনুদান দিতে পারবে এবং অনুদান প্রদানকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই তার ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে হবে। প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষার ক্ষমতাও ইসিকে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও যদি কোনো এমপির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে তার পদ বাতিল করার ক্ষমতাও থাকবে ইসির হাতে।
এছাড়া আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর প্রস্তাব রয়েছে তা হলো- দুই বা ততোধিক প্রার্থী সমান ভোট পেলে লটারির পরিবর্তে পুনরায় ভোট গ্রহণ করা হবে। তফসিল ঘোষণার ৪৫ দিন আগে থেকে ফলাফল ঘোষণার ১৫ দিন পর পর্যন্ত ইসির অনুমতি ছাড়া জেলা থেকে বিভাগীয় পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বদলি করা যাবে না। প্রার্থীদের হলফনামায় এখন থেকে দেশে ও বিদেশে থাকা আয়ের উৎস বিস্তারিতভাবে জানাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসারের পাশাপাশি 'সশস্ত্র বাহিনী' বা 'প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগ'-কে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রার্থীদের জন্য সরাসরি এবং অনলাইনের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ রাখা হবে। নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত এই সংশোধনীগুলো যদি আইন হিসেবে পাস হয়, তবে তা বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থার জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটি একদিকে যেমন নির্বাচন কমিশনের হাতকে শক্তিশালী করবে, তেমনই প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও বেশি জবাবদিহির আওতায় আনবে।
ইসির আইন সংস্কার কমিটির প্রধান, নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদের কথায়, আমরা ঐকমত্য কমিশনের মতামতকে প্রাধান্য দিচ্ছি। এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এখন ইসির প্রধান লক্ষ্য, যার সফল বাস্তবায়নই পারে গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের টলে যাওয়া আস্থাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে।
এমবি