-6886f5132a525.jpg)
সংকটে জর্জরিত বিএনপি
অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলায় নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে
শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার
দলের ভেতরে ফাটল, একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ
পেশাজীবী সংগঠনে জামায়াতপন্থিদের আধিপত্য
অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মেধাহীন নেতৃত্বে ধুঁকছে দল
দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে বিএনপি। প্রায় দেড় দশকের নির্যাতন, গুম, খুন, মামলা ও হামলার মধ্য দিয়ে দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মী জীবন-জীবিকার ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, জমিজিরেত বিক্রি করে নিঃস্ব হয়েছেন, এমনকি পলাতক জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পরও বিএনপির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি জটিলতার দিকে যাচ্ছে। দলের শৃঙ্খলা ভাঙন, নেতৃত্বের শূন্যতা এবং কোটারি-দলাদলির সমস্যা এখন দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রধান সুবিধাভোগী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-কেই ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু ক্ষমতার দোরগোড়ায় এসে দলটি এক অপ্রত্যাশিত ও জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। একদিকে দলের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলাহীনতা, কোন্দল ও স্থানীয় পর্যায়ে 'নব্য একনায়কদের' উত্থান সংগঠনকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অন্যদিকে, দীর্ঘদিনের মিত্র ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে সুবিধাবাদী ও ভিন্ন আদর্শের 'বর্ণচোরাদের' আকস্মিক উত্থান দলটিকে এক গভীর পরিচয় সংকটে ফেলে দিয়েছে। সব মিলিয়ে, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হওয়ার বদলে বিএনপি এখন আত্মপরিচয় সন্ধান ও অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসনেই বিপর্যস্ত।
ভেতরের সংকট:
দীর্ঘদিনের নিপীড়নমূলক শাসনের অবসানের পর বিএনপির মতো একটি বৃহৎ দলে উচ্ছ্বাস ও বিশৃঙ্খলা উভয়ই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রবাসে অবস্থান করায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি দৃশ্যমান শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে দলের অনেক স্তরেই শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার গুরুতর অভিযোগ উঠছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দল কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তার কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হলেও পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন সিনিয়র নেতা, যিনি নিজে একজন আইনজীবী, ক্ষোভের সঙ্গে জানান, দলের ভেতরে মেধাবী ও ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন করে সুবিধাবাদীদের পুরস্কৃত করার এক ভয়াবহ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'ধরুন একটি জেলার কোর্টে জিপি (সরকারি কৌঁসুলি) ও পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) নিয়োগ দেওয়া হলো। সেখানে দলের ত্যাগী ও মেধাবী আইনজীবীদের
বাদ দিয়ে এমন ব্যক্তিকে জিপি বানানো হলো, যার সব পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি এবং সিভিল মামলার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। তিনি জিপির চেম্বারে বসে ক্রিমিনাল মামলা পরিচালনা করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন।' তার মতে, এসব নিয়োগ আইন উপদেষ্টার মাধ্যমে হলেও এর পেছনে রয়েছে হাইকমান্ডের কাছের বলে পরিচিত স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের ইচ্ছা। এর মাধ্যমে তৃণমূলে এই বার্তা যাচ্ছে যে, বিএনপিতে যোগ্যতা বা ত্যাগের কোনো মূল্য নেই, বরং নেতার পছন্দের কোটাই চূড়ান্ত।
এই 'একনায়কতন্ত্রের' চিত্র আরও ভয়াবহ। অনেক জেলায় এখন 'এক নেতার' ইশারায় সবকিছু চলে। দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত কর্মীরাও যদি সেই নেতার মতের সামান্য বাইরে যান, তাহলেই তাদের বিরুদ্ধে নেমে আসে খড়গহস্ত। ওই নেতা বলেন, 'যে কর্মী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থেকে অসংখ্যবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, নিজের শ্রম-ঘাম-অর্থ দিয়ে কর্মসূচি সফল করেছেন, তিনি মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত হলেও জেলার নব্য একনায়কের কাছে তার কোনো মূল্য নেই। অন্যদিকে, যে ব্যক্তি কোনো দিন আন্দোলনে ছিলেন না, শুধু নেতার বাজার-সদাই করে দিয়েছেন বা বিভিন্ন পরীক্ষায় চারবার ফেল করে সার্টিফিকেট কিনে পাস করেছেন, তাকেই বেশি মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে।' এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ত্যাগী কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। দলের ভেতরে কোটারি, দলাদলি ও অনৈতিক বাণিজ্যের অভিযোগ উঠছে প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু হাইকমান্ডের আস্থাভাজন হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহসও কেউ করছেন না। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, দলের আগাগোড়া পুনর্গঠন এবং রাজনীতিতে সংস্কার আনা ছাড়া এই সংকট থেকে মুক্তি মেলা কঠিন।
বাইরের সংকট:
বিএনপির জন্য আরও বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে ঘটা নাটকীয় পরিবর্তন। এক বছরের ব্যবধানে বিএনপি যেমন নিজের দলের নেতাকর্মীদের নতুন করে চিনেছে, তেমনি দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে পরিচিত পেশাজীবীদের আসল রূপ দেখেও বিস্মিত হয়েছে। বিএনপি সমর্থিত শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও ব্যাংকারদের সংগঠনগুলোতে জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্ট এবং সুবিধাবাদী ব্যক্তিদের আকস্মিক উত্থান দলটিকে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে।
শিক্ষাঙ্গনে বিভক্তি:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াত ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষকদের সংগঠন 'সাদা দল'-এ এতদিন বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের আধিপত্য থাকলেও এখন সেই চিত্র মলিন। সাদা দল কার্যত ভেঙে গেছে। জামায়াতপন্থিরা আলাদা হলেও আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরে নিয়োগ পাওয়া বিপুল সংখ্যক তরুণ শিক্ষকও এখন তাদের সঙ্গে মিশে গেছেন, যা বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের অবাক করেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে শিক্ষকদের বৈঠকেও চিহ্নিত জামায়াতপন্থিদের উপস্থিতি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সাদা দলের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকের কথায়, “এখনকার যা অবস্থা, তাতে কেউ জামায়াতপন্থিদের বিরুদ্ধে কথা বললে, তাকেই 'জামায়াত' ট্যাগ দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলা হবে।"
ছাত্রদলে অনুপ্রবেশ:
ছাত্রদলের নেতারাও অনুরূপ অভিজ্ঞতার কথা জানান। তাদের অভিযোগ, বিগত সময়ে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা কৌশলে ছাত্রদলের কমিটিতে ছোট পদে ঢুকে পড়েছিল। ৫ আগস্টের পর তারা পদত্যাগ করে ছাত্রদলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, গুপ্ত সংগঠনের কর্মীরা ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে ছাত্রলীগ করত, এখন তারা তথাকথিত গুপ্ত দল করে। আমরা এদের চিহ্নিত করছি।
চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশাজীবী:
চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর চিত্র আরও উদ্বেগজনক। ড্যাব নেতারা অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ পদে এখন এমন ব্যক্তিরা আসীন, যারা কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংগঠন স্বাচিপের নেতা ছিলেন, কিন্তু পর্দার আড়ালে তারা জামায়াতপন্থি। ড্যাবের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ডা. শাহ মোহাম্মদ আমান উল্লাহ বলেন, "বিগত ১৭ বছর যাদের স্বাচিপ হিসেবে দেখেছি, যারা বিএনপিপন্থিদের হয়রানি করত, এখন দেখছি তারাই বড় পদে আসীন হচ্ছেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তারা ছাত্রজীবনে শিবির করতেন। তারা আওয়ামী লীগের সময়েও ভালো ছিলেন, এখনো ভালো আছেন।"
একই চিত্র কৃষিবিদ, প্রকৌশলী ও ব্যাংকারদের সংগঠনেও। জামায়াত সংশ্লিষ্টরা জোট সরকারের আমলে বিএনপির কাছ থেকে সব সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগের আমলে গিরগিটির মতো রং বদল করে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। এখন পটপরিবর্তনের পর তারা আবারও নতুন রূপে আবির্ভূত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখলের চেষ্টা করছে।
বিএনপির আগামীর পথ:
এই দ্বিমুখী সংকটে দাঁড়িয়ে বিএনপি এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। দলের নেতারা এই চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে অবগত। বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম এবং ছাত্রদল ও অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, তারা সুবিধাবাদী ও অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে কাজ করছেন। নেতাকর্মীদের ডাটাবেজ হালনাগাদ করা হচ্ছে এবং অভিযুক্তদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আগামী দিনে কমিটি গঠনেও এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা হবে বলে তারা আশ্বাস দেন।
তবে সংকট কেবল অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মূল সমস্যা দলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে। তৃণমূলের যে 'একনায়কতন্ত্র' ত্যাগী কর্মীদের হতাশ করছে, সেই বলয় ভাঙতে না পারলে দলের পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়। পর্যবেক্ষক মহল ও দলের শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেন, বিএনপির জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি হলো: ১. ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে দেশে ফিরে অথবা কার্যকর প্রতিনিধির মাধ্যমে দলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ে 'একনায়কদের' লাগাম টেনে ধরতে হবে। ২. তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব কমিটি ভেঙে দিয়ে স্বচ্ছ সম্মেলনের মাধ্যমে ত্যাগী, মেধাবী ও পরীক্ষিত নেতাদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। ৩. পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে কারা দলের প্রকৃত সমর্থক আর কারা সুবিধাবাদী, তা কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করে সংগঠনগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
৪. রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য একটি আধুনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক দর্শনের রূপরেখা জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে, যা কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, একটি গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেবে।
প্রশ্ন তুলে বিশ্লেষকরা বলছেন, যে দলটি একটি 'ফ্যাসিস্ট রেজিমের' বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম করে বিজয়ী হয়েছে, তারা কি নিজেদের ভেতরের 'ফ্যাসিজম' ও 'সুবিধাবাদ'কে পরাজিত করতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তরের ওপরই নির্ভর করছে বিএনপির নিজের এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এর প্রতিকার কী- এই প্রশ্নটি এখন কেবল একজন কর্মীর নয়, পুরো জাতির।
এমবি