Logo

বিশেষ সংবাদ

পুঁজিবাজারে হস্তক্ষেপ রোধে নজরদারি সংস্থা

Icon

মেহেদী হাসান সজল

প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৪৮

পুঁজিবাজারে হস্তক্ষেপ রোধে নজরদারি সংস্থা

পুঁজিবাজারে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ ঠেকানোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ওপর নজরদারি করতে সাত সদস্যের একটি 'ওভারসাইট বডি' বা নজরদারি সংস্থা গঠনের সুপারিশ করেছে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স। সম্প্রতি বিএসইসিকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, নতুন এ সংস্থাটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপও রোধ করবে।

টাস্কফোর্সের প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিব এবং বাজারসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত হবে এই ওভারসাইট বডি। এটি একটি স্থায়ী, আইনি কাঠামোর অধীনে কাজ করবে, যাতে কমিশন এই সংস্থার পরামর্শ বা নির্দেশনা মানতে বাধ্য থাকে। কমিশনের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য হবে।

এ বিষয়ে টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, 'একটা ওভারসাইট বডি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। বিএসইসি কোনো কিছুর ব্যত্যয় ঘটালে সেই বডি এর বিপরীতে করণীয় সুপারিশ করবে। সুশাসন বা ব্যালেন্স রাখার জন্য এটি করা হয়েছে। বিগত সময়ে দেখা গেছে, বিএসইসির যে কাজ, সেগুলো করা হয়নি। আগে এ রকম অনেক কিছু ঘটেছে। আমাদের সংস্কারের উদ্দেশ্য হলো, আগের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু যাতে না ঘটে। বিএসইসি তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে এই ওভারসাইট বডির কিছু করার থাকবে না।'

টাস্কফোর্সের আরেকজন সদস্য বলেন, এই নজরদারি সংস্থা কার্যত কমিশনের একটি বোর্ড অব ডিরেক্টরসের মতো ভূমিকা পালন করবে। আস্থা ফেরাতে তদবিরমুক্ত নিয়ন্ত্রণ দরকার: প্রতিবেদনে বলা হয়, অতীতে কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয় এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে এবং মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মতামত উপেক্ষা করে গ্রহণ করা হয়। এতে করে বাজারে আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

২০১৮ সালে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর (এমএফ) মেয়াদ ১০ বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে একটি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে টাস্কফোর্স বলেছে, এ ধরনের সিদ্ধান্তে ইউনিটহোল্ডারদের মতামত নেওয়া হয়নি। কমিশন একতরফাভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করেছে।

অভিযোগ রয়েছে, কয়েকজন অসাধু ফান্ড ম্যানেজারের তদবিরে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে তাঁরা দীর্ঘ সময় ব্যবস্থাপনা ফি নিতে পারে। অথচ অধিকাংশ ফান্ডই বিনিয়োগকারীদের কাঙ্ক্ষিত মুনাফা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মিউচুয়াল ফান্ড ও তাদের পরিচালকদের ওপর আস্থা কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো খাতের ওপর। প্রতিবেদন প্রকাশে বিলম্ব, আইপিও অনুমোদনে বিতর্ক টাস্কফোর্স বলেছে, প্রতিবছর বিএসইসির বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এতে প্রতিবেদন প্রকাশে অযথা দেরি হয়। এই প্রক্রিয়াও কমিশনের স্বতন্ত্রতা ক্ষুণ্ণ করে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনেক সময় কমিশন স্টক এক্সচেঞ্জের আপত্তি উপেক্ষা করে আইপিও অনুমোদন দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে রিং শাইন টেক্সটাইলের কথা বলা হয়েছে। এই কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ আপত্তি জানালেও কমিশন অনুমোদন দেয়। পরে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ করে কোম্পানির মালিকরা বিদেশে পালিয়ে যায়।

ফ্লোর প্রাইস আরোপের ঘটনাও আলোচনায় এসেছে। টাস্কফোর্স বলেছে, এ সিদ্ধান্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের বাজারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে।

চেয়ারম্যান নিয়োগেও স্বচ্ছতা চায় টাস্কফোর্স
টাস্কফোর্সের মতে, বিএসইসি চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা আনতে হবে। বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে নিয়োগ হয়, সেখানে যোগ্যতার তুলনায় তদবির বড় ভূমিকা রাখে। তাদের প্রস্তাব, নজরদারি সংস্থা একটি সার্চ কমিটি গঠন করবে, যা ওইসব পদে নিয়োগের উপযোগী ব্যক্তিকে বাছাই করবে। তাতে যোগ্যতা, সততা এবং পুঁজিবাজার সম্পর্কে ধারণা থাকা ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যেহেতু নজরদারি সংস্থার সদস্য হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব থাকবেন, সেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ও এই প্রক্রিয়ায় প্রতিনিধিত্ব পাবে।

আইনি কাঠামোর প্রয়োজন
টাস্কফোর্স বলছে, ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসের পর বিএসইসি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিল। এতে অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ড. জায়েদী সাত্তার, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-গভর্নর, এফবিসিসিআই সভাপতি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সদস্য ছিলেন। কিন্তু সেই কমিটি মাত্র একবার, ২০১৪ সালে বৈঠকে বসে। এরপর আর কোনো সভা হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই কমিটি অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এই অভিজ্ঞতা থেকেই টাস্কফোর্স মনে করে, একটি কাগুজে কমিটি নয়, বরং আইনি ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি কর্তৃত্বপূর্ণ নজরদারি সংস্থাই কমিশনের কার্যক্রমে সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে পারে। টাস্কফোর্সের সুপারিশে আরও বলা হয়, বিএসইসির কাজ নীতিনির্ধারণে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। বাজার পরিচালনার দৈনন্দিন সিদ্ধান্তগুলো স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর হাতে থাকা উচিত। এতে করে বাজারে স্বাভাবিক গতিশীলতা বজায় থাকবে এবং তদবিরভিত্তিক সিদ্ধান্ত কমে আসবে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, 'এসব বডি গঠনের পক্ষে আমি নই। বিএসইসি নিজের ক্ষমতা ঠিকভাবে প্রয়োগ করলে কোনো অনিয়ম হওয়ার কথা নয়। একটা বডিকে নজরদারির জন্য আরেকটা বডি গঠনের কোনো যুক্তি নেই। বিএসইসিতে যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে সঠিক আইন প্রয়োগ করলে পুঁজিবাজারে কোনো অনিয়ম হওয়ার কথা নয়।'

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

শেয়ারবাজার

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর