দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণাকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক মহল।
এর পরপরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর কথা জানিয়ে জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন। তবে এই স্বস্তির আবহের মধ্যেই 'জুলাই ঘোষণাপত্র' নিয়ে রাজনৈতিক দল ও জুলাই অভ্যুত্থানের নায়কদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ ও মতপার্থক্য। কারণ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না করা এবং এর বাস্তবায়ন নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দল এই ঘোষণাপত্র নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেও বিএনপি একে 'গণতন্ত্রের জন্য ঐতিহাসিক পদক্ষেপ' বলে অভিহিত করেছে। এসব বিষয় নিয়ে আগামী দিনের পথচলা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে গতকাল বুধবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পথে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ অবশ্যই থাকবে। তবে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নেব। নির্বাচন পর্যন্ত আমাদের প্রস্তুতিতে কোনো বিরতি থাকবে না।'
এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। একদিকে যেমন নির্বাচনের একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ পাওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো নড়েচড়ে বসেছে, অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রণীত 'জুলাই ঘোষণাপত্র' নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
ঘোষণা ও সরকারের পরিকল্পনা :
'জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস' উপলক্ষে গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তিনি নির্বাচন কমিশনকে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে, অর্থাৎ পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগেই, জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানাবেন।
ড. ইউনূস তার ভাষণে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উৎসবমুখর নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, 'এবারের নির্বাচনে প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায় সরকার। অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যাঁরা পুনরায় দাঁড় করিয়েছেন, সেই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে।' দীর্ঘ ১৫ বছর পর দেশের মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেজন্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাসও দেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি ও চ্যালেঞ্জ :
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পরপরই নির্বাচন কমিশন তাদের কর্মতৎপরতা শুরু করেছে। সিইসির বক্তব্য অনুযায়ী, ইসি পুরোদমে কাজে নেমে পড়েছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ:
প্রথমত: নতুন ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং মৃত ভোটারদের বাদ দিয়ে একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা ইসির প্রাথমিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রায় ৪৪ লাখ নতুন ভোটার এবার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেতে পারেন। দ্বিতীয়ত: এটি এবারের নির্বাচনের অন্যতম নতুন ও চ্যালেঞ্জিং সংযোজন। বিদেশে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য একটি কার্যকর ও নিরাপদ পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। পোস্টাল ব্যালট এবং অনলাইন ভোটিংয়ের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে ইসি, যার জন্য প্রায় ৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
তৃতীয়ত, জনসংখ্যা ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে ৩৯টি আসনের সীমানা পরিবর্তনের খসড়া তৈরি হয়েছে এবং আগস্টের মধ্যে এ সংক্রান্ত শুনানি শেষ করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। চতুর্থত, সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি, আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইসির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় :
নির্বাচনের ঘোষণা স্বস্তি আনলেও ৫ আগস্ট প্রকাশিত 'জুলাই ঘোষণাপত্র' বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এই ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে প্রত্যাশা ও হতাশার এক মিশ্র চিত্র ফুটে উঠেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের সময় নির্ধারণ ও জুলাই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এই ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সুগম করবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সরকার ও নির্বাচন কমিশন সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বিএনপি কাজ করবে।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী 'জুলাই ঘোষণাপত্র' নিয়ে তীব্র হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির নায়েবে আমির ডা. মোহাম্মদ তাহের বলেন, মানুষ যে প্রত্যাশা নিয়ে এতদিন অপেক্ষা করছিল, তা জুলাই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে পূরণ হয়নি। এতে দেশের জনগণের মাঝে নতুন করে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
ডা. তাহেরের মতে, এই ঘোষণাপত্রে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও ভাতার বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। ঘোষণাপত্রটি সংবিধানে স্থান দেওয়া দরকার ছিল, কিন্তু এটি কখন থেকে কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, তার কোনো দিক-নির্দেশনা নেই। জামায়াত মনে করে, একটি 'ঐকমত্য কমিশন' এর মাধ্যমে 'জুলাই জাতীয় সনদ' প্রণয়ন করা উচিত ছিল, যা ঘোষণাপত্রে প্রতিফলিত হয়নি।
গণঅধিকার পরিষদের বর্জনের হুমকি :
জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল ছাত্ররা। তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন গণঅধিকার পরিষদও ঘোষণাপত্র নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের মূল প্রেক্ষাপট, বিশেষ করে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে ধারাবাহিক ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসকে এই ঘোষণাপত্রে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর এবং সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে এবং অভ্যুত্থানের মূল কারণগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা হুমকি দিয়েছেন, যদি গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত না করা হয়, তবে তারা এই ঘোষণাপত্র বর্জন করবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের সদিচ্ছার প্রতিফলন। তবে, 'জুলাই ঘোষণাপত্র' নিয়ে যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, তা যদি দ্রুত সমাধান করা না যায়, তবে এটি আগামী দিনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাবের আহমেদ চৌধুরীর মতে, একটি গণঅভ্যুত্থানের পর প্রণীত যেকোনো জাতীয় দলিলে সব পক্ষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকা জরুরি। জামায়াতে ইসলামী এবং গণঅধিকার পরিষদের মতো দল, যারা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে, তাদের উদ্বেগ ও দাবিগুলোকে উপেক্ষা করা হলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে, একদিকে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিকে সর্বাত্মক সহায়তা করা এবং অন্যদিকে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের মধ্যে 'জুলাই ঘোষণাপত্র' নিয়ে একটি সর্বজনীন বোঝাপড়া তৈরি করা। এই দুটি কাজ সমান্তরালে এবং সফলভাবে করতে পারার ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মসৃণ উত্তরণ। আগামী কয়েক মাস তাই জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সিদ্ধান্তমূলক হতে চলেছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহরিয়ার হোসেনের মতে, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি ইতিবাচক বার্তা দিলেও বাস্তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো "আন্তঃদলীয় আস্থার সংকট" "একমাত্র সংলাপ ও একটি সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সমঝোতাই পারে আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে।"
পর্যবেক্ষণ সংস্থা 'ভোটাধিকার'- এর প্রধান নির্বাহী ফারহানা করিম মনে করেন, নির্বাচনের আগে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি, তা এখনো অনুপস্থিত। ঘোষণাপত্র দিয়ে ভোটের মাঠে নামা যথেষ্ট নয়, বরং দলগুলোকে বসিয়ে বাস্তব সমাধান খুঁজতে হবে। এ মুহূর্তে দরকার হলো স্বচ্ছ ভোটার তালিকা, নির্ভরযোগ্য ইভিএম বা ব্যালট প্রস্তুতি, পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-সব দলের অংশগ্রহণ।
বিকেপি/এমবি


