Logo

বিশেষ সংবাদ

অর্থনীতিতে সংকট কাটলেও পূরণ হয়নি প্রত্যাশা

Icon

মেহেদী হাসান সজল

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩৭

অর্থনীতিতে সংকট কাটলেও পূরণ হয়নি প্রত্যাশা

দেশের ইতিহাসে এক কঠিন অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গতকাল ৮ আগস্ট এক বছর পূর্ণ করছে। শেখ হাসিনার দীর্ঘ সময়ের ক্ষমতার অবসান, আর্থিক খাতে লাগামছাড়া দুর্নীতি, অনিয়ন্ত্রিত অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনরোষের পটভূমিতে গঠিত হয় নতুন এই সরকার।

শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পরপরই শুরু হয় আর্থিক খাতের পূর্ণ সংস্কার। এর আওতায় ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ফেরানো, দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি করা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রানীতির ভারসাম্য বজায় রাখা এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ জোরদারের কার্যক্রমে এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি দেখা দিয়েছে। তবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে খরা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পিছিয়ে পড়া এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়ার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গণমানুষের প্রত্যাশা ছিল বিপুল, সে তুলনায় প্রাপ্তি সামান্যই। অনেক প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে দেশ গঠনের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি। ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রশাসনিক অদক্ষতাসহ দেশের অনেক মৌলিক সংকট আগের মতোই বিরাজমান। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গিয়েছিল, তার অনেকই গত এক বছরে আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের

(আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী গণমাধ্যমে বলেন, 'শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির সময়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির যে নাজুক পরিস্থিতি ছিল, তা কিছুটা কাটিয়ে ওঠা গেছে। কিন্তু যে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল, সেটি পূরণ হয়নি। ব্যাংক খাতে কিছু সংস্কার হয়েছে, অর্থনীতির কিছু সূচকে উন্নতি দেখা গেছে, তবে তা প্রত্যাশার তুলনায় খুবই কম। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের অর্জন উজ্জ্বল বলা যাবে না।'

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক বছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ, রেকর্ড রেমিট্যান্স আয়, রিজার্ভ শক্তিশালী হওয়া, ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো, ওভার ইনভয়েসিংহ্রাস এবং অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে উন্নতি হয়েছে। চার বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ: অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ৪ দশমিক শূন্য ৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে ২ দশমিক ৫৯৫ বিলিয়ন ডলার ছিল মূলধন এবং ১ দশমিক ৪৯১ বিলিয়ন ডলার সুদ। আগের অর্থবছরের তুলনায় ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। এই ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছিল মূলত মেগা প্রকল্পের এবং মহামারি চলাকালে নেওয়া জরুরি বাজেট সহায়তা ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায়। এতে সরকারের ওপর আর্থিক চাপ বাড়লেও দেশের ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা ও বিশ্বস্ততা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

রেমিট্যান্সে রেকর্ড: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। হুন্ডি প্রতিরোধে প্রচারাভিযান, প্রণোদনা বৃদ্ধি ও আইনি পদক্ষেপের ফলে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানো বেড়েছে। শুধু মার্চ মাসেই এসেছে ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও এসেছে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি।

ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা: রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা এসেছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলারের দাম ১২১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২১ টাকা ৬০ পয়সার মধ্যে ছিল। জুনে ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ আগমনের ফলে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে, যা গত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এছাড়া গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের যৌথ তৎপরতায় ওভার ইনভয়েসিং উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। প্রকৃত তথ্য প্রকাশ ও নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ খেলাপি ঋণের তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংককে আন্তর্জাতিক মানের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) অনুসরণেও বাধ্য করেছে, ফলে গোপন ক্ষতগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। বৈদেশিক ঋণ চুক্তির ক্ষেত্তে নেয়া হয়েছে ভারসাম্য রক্ষায় উদ্যোগ। আলোচিত ১০ শিল্প গ্রুপের ঋণ অনিয়ম তদন্তে যৌথ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক, সিআইডি, এনবিআর এবং বিএফআইইউর সমন্বয়ে এ কমিটি গঠিত হয়। এনবিআরকে বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা নামে দুটি আলাদা বিভাগ গঠন করা হয়েছে। এতে কর আদায়ে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বেড়েছে। যদিও শুরুর দিকে কিছু কর্মচারীর বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং এ নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। পরে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে তা নিয়ন্ত্রণে আসে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও গত এক বছরে অর্থনীতিতে বেশকিছু সংস্কার হয়েছে। তবে গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল কোটা সংস্কারের মাধ্যমে বৈষম্যের বিলোপ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি। কিন্তু গত এক বছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেই পিছিয়ে আছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ সময়ে কোনো বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে পারেনি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। 

বিসিএসের মতো দেশের সরকারি ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়াও সেভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি সরকার। এতে শিক্ষাজীবন শেষ করা বেকার তরুণদের মধ্যে হতাশা আরো তীব্র হয়েছে। সরকারি চাকরির পাশাপাশি দেশের বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথও সংকুচিত হয়েছে। গত এক বছরে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। বহু বছর এ খাতে এতটা ঋণ খরা দেখা যায়নি। ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়ার অর্থ বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি নিষ্পত্তি ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ কমে গেছে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ২৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল।

বিকেপি/এমবি 

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর