Logo

বিশেষ সংবাদ

জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেও স্বস্তিতে নেই বিএনপি, সামনে চ্যালেঞ্জের পাহাড়

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫৬

জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেও স্বস্তিতে নেই বিএনপি, সামনে চ্যালেঞ্জের পাহাড়

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের রাজনীতির মাঠ এখনো অস্থির। এই অস্থিরতার মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি, কিন্তু বিএনপির সামনে দাঁড়িয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ।

অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ ১৫ বছরের নিপীড়ন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ফলে দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন তুঙ্গে। কিন্তু ক্ষমতার হাতছানির সঙ্গে দলটির সামনে উপস্থিত হয়েছে কঠিন বাস্তবতা এবং পর্বত সমান চ্যালেঞ্জ। দেশজুড়ে নেতাকর্মীদের একাংশের বিরুদ্ধে দখল, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির অভিযোগ, ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এবং দলের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা- এই সংকট বিএনপির অর্জিত বিপুল জনসমর্থনকে এক বড় অগ্নিপরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়েছে।

যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পতন ঘটানোর পর বিএনপি এখন তার সাথীদের সঙ্গে বোঝাপড়া বাড়াতে তৎপর, কিন্তু দলের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক, আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির অভিযোগ এবং ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব-এসব কারণে আগামী নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন ধরে রাখা দলটির জন্য বড় পরীক্ষা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চ্যালেঞ্জগুলোকে সামলাতে না পারলে বিএনপির পুনরুত্থান ব্যাহত হতে পারে।

তৃণমূলের বাস্তবতা :
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশব্যাপী যে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তার সুযোগ নিচ্ছে বিএনপির তৃণমূলের একশ্রেণির নেতাকর্মী। বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযোগ আসছে যে, স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নামে জমি দখল, বাজার নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডারবাজি এবং চাঁদাবাজির মতো ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, পতিত আওয়ামী লীগের অনেক সুবিধাবাদী কর্মী ও নেতা নিজেদের বাঁচাতে রাতারাতি বিএনপিতে যোগ দিচ্ছে এবং এসব অপকর্মে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

এই পরিস্থিতি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ঘোষিত নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ সম্প্রতি খুলনার এক আলোচনা সভায় যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, 'জনগণ আমাদের হয়তো ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ যা করেছে আমরাও যদি তা করি, তাহলে ১৫ দিনও ক্ষমতায় টিকতে পারব না।' তার এই বক্তব্য প্রমাণ করে, দলের হাইকমান্ড তৃণমূলের এই চিত্র সম্পর্কে অবগত এবং এর ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে শঙ্কিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কেন্দ্র থেকে এখনই যদি এই অপতৎপরতা কঠোর হাতে দমন করা না যায়, তাহলে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি হয়েছিল, তা দ্রুতই বিএনপির বিরুদ্ধে চলে যাবে।

কৌশলগত সংকট :
যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল, যেখানে বাম, ডান ও ইসলামপন্থি সব ধারার দলই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কর্মকাণ্ডে ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে একটি সূক্ষ্ম দূরত্ব তৈরির আভাস পাওয়া যাচ্ছে, যা দলটির জন্য একটি বড় কৌশলগত সংকট তৈরি করতে পারে।

গত ৯ আগস্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গণতন্ত্র মঞ্চসহ বেশ কয়েকটি বাম-গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকে 'দক্ষিণপন্থার বিস্তার' কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক পরিভাষায় 'দক্ষিণপন্থা' বলতে প্রায়শই ইসলামপন্থি রাজনীতিকে বোঝানো হয়। এ ধরনের আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই ইসলামপন্থি দলগুলোকে, যারা বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র, সন্দিহান করে তুলছে। তারা মনে করছে, বিএনপি হয়তো পশ্চিমা বিশ্ব ও দেশের সেক্যুলার শক্তিকে তুষ্ট করতে তাদের থেকে দূরত্ব তৈরি করছে। যদি এই ধারণা সত্যি হয়, তবে ভোটের মাঠে বিএনপিকে এর বড় মূল্য দিতে হতে পারে, কারণ ইসলামপন্থি দলগুলোর একটি নির্দিষ্ট এবং সংগঠিত ভোটব্যাংক রয়েছে যা নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা :
দল হিসেবে বিএনপি কতটা ঐক্যবদ্ধ, সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। একদিকে মেজর হাফিজের মতো নেতারা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের ধীরগতি এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপদেষ্টাদের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এই ভিন্ন সুর দলের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতারই ইঙ্গিত দেয়।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবাসী নেতাদের দেশে ফিরে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার হিড়িক। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিএনপির বহু নেতা দেশে ফিরে নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছেন। যদিও তাদের অনেকেই বলছেন, মনোনয়ন পেলে বিদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করবেন, কিন্তু প্রশ্ন উঠছে স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে। যে নেতারা গত ১৫ বছর ধরে দেশের মাটিতে থেকে মামলা-হামলা সহ্য করে রাজনীতি করেছেন, তারা কি এই 'প্যারাসুট' নেতাদের সহজভাবে মেনে নেবেন? এটি মনোনয়ন পর্যায়ে দলের মধ্যে তীব্র কোন্দল তৈরি করতে পারে, যা চূড়ান্তভাবে নির্বাচনের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জনসমর্থন হারানোর ভয় :
বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এবং দখলবাজির অভিযোগ উঠেছে, যা দলের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রবাসী নেতারা যেমন যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক এবং যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক নেতারা নির্বাচনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু অনেকে বিদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে রাজি। কিন্তু স্থানীয় দলের নেতাকর্মীদের আচরণ জনগণকে বিমুখ করছে। সম্প্রতি আলজাজিরার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থি বিস্তার ঘটছে, যা গণতান্ত্রিক দলগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে সহযোগী অধ্যাপক ও অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট লেকচারার এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শফি মো. মোস্তফা বলেন, নিঃসন্দেহে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বিএনপিকে এক ঐতিহাসিক সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারলে তা মহাবিপর্যয় ডেকে আনে। তাই বিএনপিকে তার অভ্যন্তরীণ সংস্কার করতে হবে, অন্যথায় জনসমর্থন হারাবে।

সম্প্রতি এক সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের যে কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, বিপ্লবোত্তর যে দেশ দ্রুত নির্বাচন করেছে, তারা ভালো করেছে। তার এই বক্তব্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দীর্ঘসূত্রতার প্রতি এক ধরনের পরোক্ষ সমালোচনা। তিনি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা একটি আধুনিক রাষ্ট্রভাবনার পরিচায়ক। কিন্তু দলের তৃণমূল যদি দখলবাজি আর চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত থাকে, তবে এই আধুনিক ভাবনা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।

এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক রাশিদুল ইসলাম বলেন, বিএনপি এখন "ভিক্টর'স ডিলেমা" বা বিজয়ীর উভয় সংকটে ভুগছে। তারা আন্দোলন করে সফল হয়েছে, কিন্তু সেই সাফল্য ধরে রাখার জন্য যে শৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রয়োজন, তার অভাব দেখা যাচ্ছে। তৃণমূলের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এবং মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারলে এই বিপুল জনসমর্থন খুব দ্রুতই ক্ষয় হয়ে যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, বিএনপিকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কাদের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করতে চায়। সেক্যুলার ও ইসলামপন্থি-দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা কঠিন। যুগপৎ আন্দোলনের ঐক্য ছিল মূলত 'সরকার পতন'কেন্দ্রিক। এখন রাষ্ট্র গঠন ও নির্বাচনের প্রশ্ন আসায় আদর্শিক বিভেদগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। 

বিএনপির উচিত হবে, সব মিত্রকে নিয়ে একটি ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে জাতীয় সনদ বা চুক্তি সম্পাদন করা, যা ভবিষ্যৎ সরকার পরিচালনার গাইডলাইন হবে। দলের নেতাকর্মীদের সংযত আচরণ, সব মিত্রশক্তিকে আস্থায় রাখা এবং একটি সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় সংস্কার পরিকল্পনা জনগণের সামনে তুলে ধরাই এখন বিএনপির প্রধান কাজ। যদি দলটি নিছক ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে আদর্শ ও শৃঙ্খলাকে বিসর্জন দেয়, তবে তাদের অবস্থাও পূর্বসূরিদের মতোই হতে পারে। তাই আগামী কয়েকটি মাস বিএনপির জন্য শুধু নির্বাচনি প্রস্তুতির সময় নয়, বরং আত্মশুদ্ধি ও সঠিক পথ নির্ধারণেরও এক অগ্নিপরীক্ষার সময়।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বিএনপি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর