বিএনপির ওপর নির্ভর করছে ইসলামী দলের নির্বাচনী জোট

এম. ইসলাম
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৫, ০৯:১৫

- জোট গঠন প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক সাড়া : গোলাম পরওয়ার
- ইসলামী দলগুলোতে বোঝাপড়া ঘনিষ্ঠ হচ্ছে : মামুনুল হক
- জনগণ ইসলামী দলের ঐক্য চায় : ইউনুছ আহমাদ
- জোট হবে কিনা বলার সময় আসেনি : ড. দিলারা চৌধুরী
দেশের ইসলামী দলগুলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধ ভোট করতে পারবে কিনা তা নিয়ে ক্রমেই সংশয় বেড়েছে। অনুসন্ধান বলছে, বিএনপি শেষভাগে নির্বাচনী জোট করলে অনেকেই সেদিকে ঝুঁকতে পারে এমন আশঙ্কায় ঐক্য ধরে রাখা নিয়ে সংশয় রয়েছে ইসলামী দলে। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে আসন বণ্টন ও মতাদর্শে ছাড় দিয়ে সবাইকে কতটুকু খুশি রাখা যাবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তাই গত বছরের ৫ আগস্টের পর দলগুলোতে 'আদর্শিক দূরত্ব' কমলেও জোট গঠন চূড়ান্ত না হওয়ায় এখন আদৌও তা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, ঐক্যে ফাটলের শঙ্কায় তারা এখনই সব কিছু প্রকাশ্যে আনবেন না। আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জোট হবে কিনা তা এখনো বলার সময় আসেনি। গত বছরের ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর ইসলামী দলগুলো জোট গঠনে তৎপর হয়। বিশেষ করে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন এ বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে কাজ শুরু করে। দলগুলোর মধ্যে প্রায়ই নানা ইস্যুতে বৈঠক চলতে থাকে।
সবশেষ গত ১৯ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের জাতীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ইসলামী আন্দোলনসহ ৮টি ইসলামী দলের শীর্ষ নেতারা দলটির সাত দফার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এছাড়া গত ২৮ জুন ঢাকায় চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমাবেশে জামায়াতসহ বেশির ভাগ দলের নেতারা অংশ নেন। এ দুটি বৈঠকের পর ফের ইসলামী দলের ঐক্য গঠন কোন পর্যায়ে আছে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ হাতেগোনা ৫-৬টি দলের কার্যক্রম রয়েছে মাঠ পর্যায়ে। আগামী সংসদ নির্বাচনে জোট হচ্ছে এমন আলোচনা রয়েছে দলগুলোর কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ে। জোট হলে কোন দল কতটি আসন পাবেন তা এখনো চূড়ান্ত না হলেও ইসলামী দলের পক্ষে একজনকে প্রার্থী করা হবে এমন আলোচনা চলছে। সেক্ষেত্রে যাকে সমর্থন দেওয়া হবে ওই প্রার্থী তার দলের 'প্রতীক' ব্যবহার করবেন।
জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনেই ইতিমধ্যে তিনটি ক্যাটাগরিতে প্রার্থী বাছাই করেছে। আবার সব আসনে ইসলামী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ কয়েকটি দল কিছু আসনে প্রার্থী তালিকা করেছে। দলগুলোর একাধিক সূত্র বলছে, সব আসনে প্রার্থী নিয়ে আলোচনা থাকলেও ১৫০ আসনে 'বিশেষ লড়াইয়ে' প্রার্থী দিতে চায় দলগুলো। যার মধ্যে জামায়াতের বাছাইকৃত 'এ' ক্যাটাগরির ৯০ আসন, ইসলামী আন্দোলনের ৪০, মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ১০, জমিয়তে ওলামা ইসলাম (একাংশ) ৫, খেলাফত মজলিস ৩ ও নেজামে ইসলামের ২টি আসনের প্রার্থী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া জোট না হলেও গত বছরের জুলাই-আগস্টে সরকার পতন আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শীর্ষ নেতাদের ৫টি আসনে ইসলামী দলগুলো প্রার্থী দিতে চায় না।
ইসলামী দলগুলোতে আশঙ্কা রয়েছে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য গড়ার যে ঘোষণা দিয়েছে সেখানে যদি তাদের কিছু দলকে কাছে টানতে চায় তাহলে ঐক্যে সংকট দেখা দিতে পারে। ইতিমধ্যে গত সপ্তাহে বিএনপি জমিয়তে ওলামা ইসলামের একাংশসহ তিনটি দলের সঙ্গে বৈঠকও করেছে। প্রাথমিকভাবে দলগুলোকে কিছু আসন ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে বিএনপি ইতিবাচক বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ খবর ইসলামী দলের ঐক্যে সংশয়ের একটি বড় কারণ। এছাড়া জামায়াতের 'মওদুদীবাদ' আদর্শ নিয়ে অনেকের আপত্তি রয়েছে। অর্থাৎ দলগুলো নিজেদের মধ্যে আদর্শিক ছাড় কতটুকু দেবে সেটি নিয়ে অনেকের মাঝে শঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি আসন বণ্টনে শেষ পর্যন্ত সবাইকে খুশি রাখা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে দলগুলোতে নির্বাচন জোট হবে কিনা?
তবে, ঐক্য প্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কায় 'কৌশলী' দলগুলো এখনই কিছু পরিষ্কার করতে চাইছে না। মাঠ পর্যায়ে বার্তা রয়েছে, তফসিল ঘোষণার ঠিক আগমুহূর্তে বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে। এখন নিজেদের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। দীর্ঘদিন এমন আলোচনা চললেও কেন জোট গঠন প্রক্রিয়া এগোচ্ছে না তা নিয়ে খোদ দলের নেতাদের মাঝে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এদিকে গত ৫ আগস্টের পর 'মওদুদীবাদ মতাদর্শ' নিয়ে জোরালো আপত্তির পরও জামায়াতের আহ্বানে কওমি আলেমদের পাশাপাশি নানা ঘরানার ইসলামী দলের নেতারা বিভিন্ন সময়ে সাড়া দিতে থাকেন। ইসলামী আন্দোলনও সভা-সেমিনার শুরু করে। নির্বাচনকেন্দ্রিক ঐক্য এবং আদর্শিক দূরত্ব কমানোই যার মূল লক্ষ্য ছিল।
বৈঠকের ইতিবাচক প্রভাব পড়তেও শুরু করে। জানা গেছে, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনকে আওয়ামী লীগের 'সহযোগী' আখ্যা দিয়ে জামায়াত নেতারা বক্তব্য দিতেন। অথচ সরকার পতনের পর দল দুটি নেতারা বারবার এক মঞ্চে বসার পর এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া বন্ধ করে জামায়াত। আবার ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম জামায়াতের বিরুদ্ধে মাঠ গরম করা বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। মাঠ পর্যায়ে এ দল দুটি ছাড়াও বেশির ভাগ ইসলামী দলে ঐক্যের আভাস মিলছে।
এতো তৎপরতা চালালেও অজানা কারণে জোট গঠনের প্রক্রিয়া দৃশ্যমান না হওয়ায় আদৌও চূড়ান্ত রূপ পাবে কিনা তা নিয়ে অনেকে শঙ্কাও প্রকাশ করছেন।
জামায়াতের ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সরকার পতনের আগেই ইসলামী দলগুলোর ঐক্যে আগ্রহ ছিল। কিছু মতপার্থক্য থাকলেও সেটি এখন একটি ইতিবাচক জায়গায় দাঁড়িয়েছে। জোট গঠনে সংশয় উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সময় সব কিছু বলে দেবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, 'ইসলামী দলগুলোর বৃহৎ ঐক্যের ব্যাপারে বোঝাপড়া ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। দলগুলোকে এককাতারে দেখতে চাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা দেশবাসীর রয়েছে সেটি পূরণে আমি আশাবাদী।'
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, 'বিভিন্ন সময়ে বড় দলের ভূমিকায় হতাশ দেশবাসী। আওয়ামী লীগ পতনের পর বিএনপির অনেকের চাঁদাবাজির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ইসলামী শক্তি এককাতারে এলে মানুষ ভালো থাকবেন বলে ধারণা করছেন। জামায়াত ইসলামীর আদর্শগত বিষয়ে কওমি আলেমদের অনেকের আপত্তি থাকলেও আমরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছি।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত জোট হচ্ছে বলা যাবে না। জোট হলে ভোটে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে না পারলেও তারা শক্তির জানান দিতে পারে। বিএনপি বিগত সময়ে জামায়াতের সঙ্গে জোট করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনার শিকারের পর দলটি এবার ইসলামপন্থিদের সঙ্গে জোট গঠনে সতর্ক।
জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত ইসলামী দলের সংখ্যা ১২টি। যার মধ্যে রয়েছে-জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামিক ফ্রন্ট, খেলাফত আন্দোলন, তরীকত ফেডারেশন, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী ফ্রন্ট, জাকের পার্টি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি। এর মধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রায় এক যুগ জামায়াতের নিবন্ধন ও প্রতীক স্থগিত থাকলেও সম্প্রতি আপিল বিভাগের নির্দেশে তা ফিরে পেয়ছে। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে ৫০টিরও বেশি দল থাকলেও হাতেগোনা ৫-৬টি বাদে অন্য ইসলামী দলগুলো ব্যানার সর্বস্ব।
বিকেপি/এমবি