
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন-পরবর্তী সময়ে দুর্নীতিবাজদের ধরপাকড়ে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার ক্ষেত্রে রেকর্ড সাফল্য দেখিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের রায় এবং দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট এসব সম্পদ জব্দ করেছে। সম্প্রতি দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম জানান, গত এক বছরে দুদক অনুসন্ধানে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৮৪৫টি। এর মধ্যে ৪৫২টি মামলা দায়ের করেছে। গত এক বছরে মামলায় আসামি হয়েছেন ১ হাজার ৭৪৩ জন। এক বছরে চার্জশিটে দেওয়া হয়েছে ৩৪৮টি।
দুদক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবীরা দেশ-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এসব সম্পদ এখন তারা বেচে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই বিদেশ থেকে বাংলাদেশে তাদের সম্পত্তি বিক্রি করতে কাউকে কাউকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিচ্ছেন বলে দুদক জানতে পেরেছে। যাদের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে সেই তালিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাবেক সজীব ওয়াজেদ (জয়) ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকি (ববি)।
এ ছাড়া রয়েছেন, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সালমান এফ রহমান, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদসহ সাবেক সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা দেশের সম্পদ করেছে তাদের তালিকা নিয়েও কাজ করছে দুদক। মামলার তদন্ত ও বিচার শেষ হওয়ার আগে যাতে এসব অবৈধ সম্পদ কেউ বেচতে না পারেন, সে জন্য সম্পদ জব্দ করে রাখায় তৎপর দুদক। গত বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত জব্দসংক্রান্ত আদেশ দিয়েছেন।
দুদক বলছে, ক্ষমতার অপব্যবহার, বড় বড় প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি করে অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দ নেওয়া ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলের অভিযোগ রয়েছে। আসামিদের কেউ কেউ টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন ও কানাডায় একাধিক বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, এমন অভিযোগেও মামলা হয়েছে। শেয়ারবাজারে জালিয়াতি, প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের হাজার কোটি টাকা লোপাট, প্রভাব খাটিয়ে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগও রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। কারও কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলের অভিযোগ রয়েছে। আসামিদের কেউ কেউ টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন ও কানাডায় একাধিক বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, এমন অভিযোগেও মামলা হয়েছে।
আদালত ও দুদকের সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রের গত মার্চের এক তথ্যে জানা গেছে, সেই সময়ে দেশের ভেতরে প্রায় ১২ হাজার ১৩৮ কোটি ৭৭ লাখ ২০ হাজার ৭৭০ টাকার সম্পদ ক্রোক করেছে দুদক। এ সময়ের মধ্যে আদালতের আদেশে ৭৭৩ কোটি ৬২ লাখ ৫৪ হাজার ৪০৩ টাকা অবরুদ্ধ করেছে সংস্থাটি। অন্যদিকে, দেশের বাইরে ১২০ কোটি ৪৪ লাখ ২৪ হাজার ৬৮ টাকা মূল্যের সম্পদ ক্রোক এবং ৪৫ কোটি ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। গত ৫ মাসেও এ আদালত এবং দুদক আরও ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্রোক, অবরুদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করেছে। অনেক ক্ষেত্রে সে সব সম্পত্তি দেখভালের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রতিনিধি।
ক্রোক করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ১৯১ একর জমি, বিদেশে ৫৮২টি ফ্ল্যাট, দেশে ২৮টি বাড়ি, ৩৮টি ফ্ল্যাট, ১৫টি প্লট, ২৩টি গাড়ি, ২৩টি কোম্পানির ৮ লাখ ৮৮ হাজার ডলার, ৮৬ লাখ ২০ হাজার ৪৮০ ইউরো, তিনটি কোম্পানি ও তিনটি জাহাজ। এছাড়া এক হাজার ১০টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব হিসাবে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ৮১৭ কোটি ১৪ লাখ। অবরুদ্ধ করা হয়েছে ৮ হাজার ৭১৩ কোটি টাকার শেয়ার, ৬৬০ গ্রাম সোনা, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ ডলার, ৫৫ হাজার ইউরো এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৯টি বিও হিসাবে ৯ কোটি ১৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা স্থিতি। ব্যাংক স্থিতি ৭ লাখ ১৩ হাজার ডলার ও ২৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮০ ইউরো।
ক্রোক করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে- ১৯১ একর জমি, বিদেশে ৫৮২টি ফ্ল্যাট, দেশে ২৮টি বাড়ি, ৩৮টি ফ্ল্যাট, ১৫টি প্লট, ২৩টি গাড়ি, ২৩টি কোম্পানির ৮ লাখ ৮৮ হাজার ডলার, ৮৬ লাখ ২০ হাজার ৪৮০ ইউরো, তিনটি কোম্পানি ও তিনটি জাহাজ। এছাড়া এক হাজার ১০টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন রেহানা সিদ্দিকের পরিবারের সম্পদ, শিকদার গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ ও সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী-এমপি ও আমলা। আরও আছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ অন্তত শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, যে পরিমাণ সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়েছে তার পরিমাণ নিঃসন্দেহে বিপুল। এর আগে এত কম সময়ে এত পরিমাণ সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার রেকর্ড নেই। এসব সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট বিষয়টি দেখছে। পাশাপাশি ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা সম্পদের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট এটি নিয়ে কাজ করছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে থাকায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করার কারণে এটা (মামলা ও সম্পদ জব্দ) সম্ভব হয়েছে। তবে তদন্তের দুর্বলতার কারণে অপরাধ প্রমাণে সমস্যা যেন না হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। আর রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে দুদক যে সক্রিয় থাকে না, সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
দুদক জানায়, সাধারণত আদালতের ভিন্ন কোনো নির্দেশনা না থাকলে ক্রোক বা অবরুদ্ধ করা সম্পদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করে দুদকের ব্যবস্থাপনা ইউনিট। ২০১৯ সাল থেকে কমিশনের স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিট যাত্রা শুরু করে।
বর্তমানে ওই ইউনিটের অধীনে ২০২৪ সালে আদালতের আদেশে ১৭০ কোটি ৫৫ লাখ ৩২ হাজার ৩৩ টাকার সম্পত্তি ক্রোক এবং ১৯০ কোটি ৯০ লাখ ১১ হাজার ১৪০ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়। ২০২৩ সালে ২৮৩ কোটি ৪২ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৫ টাকার সম্পদ ক্রোক এবং ১৩২ কোটি এক লাখ ৯৩ হাজার ১০০ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়।
একইভাবে ২০২২ সালে ৫৮৫ কোটি ৯২ লাখ ৫৮ হাজার ১৫৬ টাকার সম্পত্তি ক্রোক এবং ২২৪ কোটি ৭৯ লাখ ৭৫ হাজার ১৬৬ টাকা ও ২৭ হাজার ৯৫৪ মার্কিন ডলার অবরুদ্ধ করা হয়। ২০২১ সালে ৩২৬ কোটি ৭১ লাখ ৪৬ হাজার ৬২৮ টাকার সম্পত্তি ক্রোক এবং এক হাজার ১৬১ কোটি ৫৮ লাখ ১৪ হাজার ৪৮০ টাকার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা (পাউন্ড, কানাডিয়ান ডলার, অস্ট্রেলিয়ান ডলার) অবরুদ্ধ করা হয়। ২০২০ সালে আদালতের আদেশে ১৮০ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৬ টাকার সম্পত্তি ক্রোক এবং ১৫২ কোটি ৯২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৯৬ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়।
বিকেপি/এমবি