
- বিএনপিসহ কয়েকটি দল এ পদ্ধতির বিপক্ষে
- বাস্তবায়নে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন কর্মসূচিতে
- ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে একমত এনসিপি
- মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষকদের
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি নিয়ে বিভক্তিতে দেশের রাজনীতির মাঠ এখন টালমাটাল। বিএনপিসহ কয়েকটি দল এই পদ্ধতির বিপক্ষে। আর জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন এই পদ্ধতি বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে রাজপথে নেমেছে। ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে একমত এনসিপিও।
দলগুলোর নেতারা এ ইস্যুতে যে যার দলের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন। বিশ্লেষকদের মাঝেও বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে পিআর পদ্ধতি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই পদ্ধতি চালুর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
এসব দলের নেতারা প্রতিদিন এই ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। বিএনপি নেতারা পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। তারা বলছেন, বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতায় এ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। এতে সরকারের ভিত্তি দুর্বল হবে। আর জামায়াত, চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) মনে করছে, ফের ফ্যাসিবাদ শাসন ব্যবস্থা যেন ফিরে না আসে সেজন্য এটি চমৎকার ব্যবস্থা। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেকের ভোট কাজে লাগে।
ফলে, কোন দলের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় না। অন্যান্য দাবির সঙ্গে পিআর বাস্তবায়নে গত ১৩ আগস্ট ঢাকা মহানগরে জামায়াত বিক্ষোভ করেছে। একই ইস্যুতে ঢাকায় বিক্ষোভের পর আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশব্যাপী জেলা ও উপজেলায় ১৫ দিনব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ডেকেছে দলটি। এনসিপি নেতারা এই দাবি বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাচ্ছেন। পিআর পদ্ধতির স্বপক্ষে থাকা দলগুলো তাদের দাবি বাস্তবায়ন না হলে ভোটে যাওয়া নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছে। তবে, বিএনপি বলছে এসব দল ভোট পেছাতে তালবাহানা করছে।
রাজনৈতিক দলের নেতারা যা বলছেন :
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণ আদৌ কিছু জানেন কি না তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এ পদ্ধতিতে ভোট হলে সেটি দলকে ভোট দেওয়া হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিকে না, দলকে ভোট দেবেন এবং দল এমপি মনোনীত করবে। আপনার এই এলাকায় নির্দিষ্ট কোনো এমপি থাকবে না। পিআর দাবি তুলে কতিপয় দল নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র করছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এ পদ্ধতি চালু হলে কালো টাকা, পেশিশক্তি, মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হবে। কারণ, তখন প্রত্যেকের ভোট কাজে লাগবে। কেউ ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে এমপি হবেন। আর কেউ ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়েও কোনো কাজে আসবে না- এটা হতে পারে না।
তিনি বলেন, 'পৃথিবীর ৯১টি দেশে পিআর পদ্ধতি চালু আছে। সেখানে গণতান্ত্রিক পথ আরও সুগম হয়েছে। তাই আমরা এটি বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলছি। যারা এর বিরোধিতা করছেন তারা ফের ফ্যাসিবাদ ফেরাতে চান।'
এনসিপির সদস্য সচিব আকতার হোসেন বলেন, ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এটি শাসক দলের স্বরতান্ত্রিক হওয়ার থেকে দেশকে রক্ষা করবে। সাম্যের বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে হলে পিআর পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনূস আহমাদ বলেন, 'এ দেশে সঠিক নির্বাচনি এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পিআর পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। সবার ভোট যখন কাজে লাগবে তখন কেউ শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট হতে পারবেন না। এ নিয়ে আমরা রাজপথে কর্মসূচি পালন করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকব।'
বিশ্লেষকদের ভাবনা :
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, পিআর পদ্ধতি অবশ্যই ভালো। এতে সবার ভোট কাজে লাগে। তবে, পিআর এর মাধ্যমে ভোটের পর গঠিত সরকার অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়। অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিতে বাধার মুখেও পড়তে হয়। এজন্য অনেকে এর বিরোধিতা করেন। তবে, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভিসি ড. আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে স্বৈরতন্ত্রমুক্ত রাখতে পিআর পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত ভালো। এর মাধ্যমে জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের সুযোগ থাকে। একটি দলের হাতে সবকিছু থাকে না।
পিআর পদ্ধতি কী :
প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রত্যেকের ভোটের মূল্যায়ন হয়। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি জনগণের মতামতের প্রতিফলন হওয়ার সুযোগ থাকে। দেশের বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় দেখা যায়, একটি দল সীমিত ভোট বেশি পেয়ে অধিকাংশ আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, সামান্য ভোটে হেরে কোনো দলের কোনো আসনই থাকে না। ধরা যাক, চারটি দল একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। একজন প্রার্থী ২৫% ভোট পেলেও বাকিরা মিলে ৭৫% ভোট পেলেও, প্রচলিত পদ্ধতিতে সেই ২৫% প্রার্থীই জয়ী হবে।
অর্থাৎ ৭৫% ভোটের কোনো কার্যকর প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। এমন বৈষম্য থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে বিশ্বের বহু দেশ গ্রহণ করেছে পিআর পদ্ধতি। আনুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে কোনো দল যদি ১০% ভোট পায়, তাহলে সংসদে তাদের আসনও হবে প্রায় ১০% হারে। প্রথমবার ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে চালু হয় পিআর পদ্ধতি। বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪% দেশে পিআর পদ্ধতিতে ভোট হয়।
বিকেপি/এমবি