‘জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ’ নিয়ে মানুষের অস্পষ্ট ধারণা : বাড়ছে রাজনৈতিক সংকট

এম. ইসলাম
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১০:২৬

রাজনীতিতে এ মুহূর্তে আলোচিত 'জুলাই ঘোষণাপত্র' ও 'জুলাই জাতীয় সনদ' সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই বেশির ভাগ মানুষের। যে ইস্যুতে দেশে রাজনৈতিক সংকট বাড়ছে সে বিষয়ে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা খোদ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জড়িত অনেকে স্পষ্ট নয়। তাদের অনেকেই 'ঘোষণাপত্র ও সনদকে' একই বিষয় মনে করছেন। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের অনেকেও বিষয়টিতে একেবারেই অপরিচিত।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের চেতনা সংরক্ষণ এবং ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান যেন না ঘটে সেজন্য সরকার ও রাজনীতিবিদদের এ বিষয়ে জনসাধারণকে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু ক্ষমতাকেন্দ্রিক চর্চায় সেটি ব্যর্থ হয়েছে।
জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানের বছরপূর্তিতে গত ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতিতে খসড়া জুলাই ঘোষণাপত্র উত্থাপন করেন। একই দিন রাতে তিনি ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এরপরই দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠে 'জুলাই ঘোষণাপত্র' ও 'জুলাই জাতীয় সনদ'। কারণ, নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ঘোষণাপত্র ও সনদ নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। বিএনপিসহ ছোট কয়েকটি দল ঘোষণাপত্রকে স্বাগত স্বাগত জানিয়ে বলছে, খসড়ার প্রস্তাব অনুয়ায়ী পরবর্তী সংসদ এটিকে আইনি ভিত্তি দেবে। তবে, জামায়াত ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল এটিকে এখনই আইনি বা সাংবিধানিক ভিত্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। যার ভিত্তিতে নির্বাচন চাইছে তারা। প্রশ্ন উঠেছে, যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে এতো আলোচনা সে সম্পর্কে মানুষ আসলে কতটুকু জানেন।
অনুসন্ধান বলছে- আলোচিত এ বিষয় সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষের পরিষ্কার ধারণা নেই। অনেকের ধারণা ঘোষণাপত্র ও সনদ একই বিষয়। আবার অনেকে এ শব্দের সঙ্গে একেবারেই অপরিচিত। বিষয়টি জানতে দৈনিক বাংলাদেশের খবরের পক্ষ থেকে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হয়।
জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া এনসিপির জেলা পর্যায়ের চারজনের সঙ্গে কথা জানা গেছে, তিনজনই জানেন না জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ কী। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এসনিপি) যুগ্ম-মুখ্য সমন্বয়ক আরিফুর রহমান তুহীন বলেন, এটি সর্বজনীন ব্যর্থতা। নির্বাচন নিয়ে বেশি ব্যস্ত হওয়ায় আমরা জুলাইকে ভুলে যাচ্ছি। এমনকি বিগত সরকারের আমলের গুম, খুনের বিষয়ও অনেকে ভুলতে বসেছে।
রাজনৈতিক কর্মী সমর্থক ছাড়াও জনসাধারণের বড় একটি অংশ এ শব্দের সঙ্গে এখনো পরিচিত হতে পারেননি। একাধিক শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে যার প্রমাণ মিলেছে। এবি ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখার ব্যবস্থাপক জাহিদ মনা বলেন, সারা দিন টিভিতে জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ নিয়ে বক্তব্য শুনি। কিন্তু আসলে আমার নিজেরই এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা: বিষয়টি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী দৈনিক বাংলাদেশের খবরকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধরে রাখতে ও ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশ গড়তে জুলাই ঘোষণাপত্র এবং সনদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের বর্তমান সরকার এটি আসলে মানুষের কাছে সেভাবে পরিচিত করতে পারেনি। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে এক্ষেত্রে উদাসীন দেখা গেছে। সারা দিন এ বিষয়ে বক্তব্য দিলেও দলগুলোর বেশির ভাগ কর্মীর এ বিষয়ে ধারণা না থাকাটা দুঃখজনক।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, অভ্যুত্থানের চেতনা সংরক্ষণে জনমত তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতা সরকারের চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বেশি। দলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক চর্চা এর জন্য দায়ী।
জুলাই ঘোষণাপত্র: গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতি এবং গণঅভ্যুত্থানের বছর বছরপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা ২৮ দফার জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। যা পর্যালোচনা করে জানা গেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র হলো- ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের দলিল, যার মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমিকার কথা পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এই ঘোষণাপত্রে স্থান পাবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আওতায় অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করে। ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই দফার সংলাপ করে মূলত জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ নিয়ে আলোচনা করে।
জুলাই সনদ: সরকারের গঠিত ঐকমত্য কমিশন প্রথম ধাপে ১৬৬ প্রস্তাব নিয়ে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপে বসে। এর মধ্যে ৬২ প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়। দ্বিতীয় ধাপে ২০ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। গত ২৯ জুলাই দলগুলোকে সনদের খসড়া দেয় কমিশন। খসড়া নিয়ে দলগুলো মতামতও দিয়েছিল, যার ভিত্তিতে সমন্বিত খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ সপ্তাহে বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হবে বলেও জানিয়েছে কমিশন।
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে যে 'বিশেষ সনদ বা দলিল' তৈরি করা হচ্ছে সেটিই মূলত 'জুলাই সনদ'।
আলোচিত বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলে বিভক্তি: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকারের ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে। দলটি বলছে- জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদকে নির্বাচিত সরকার আইনি ভিত্তি দেবে। অন্যদিকে, জামায়াত ইসলামী, জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনসহ বেশির ভাগ ইসলামী দল জুলাই ঘোষণাপত্রকে অপূর্ণাঙ্গ দাবি করে।
এসব দলের নেতারা জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার পর সেই ভিত্তিতে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান। এ দাবি আদায়ে কয়েকটি দল এখন মাঠের কর্মসূচিও পালন করছে। আগে জুলাই ঘোষনাপত্র ও সনদের আইনি ভিত্তি, জুলাই গণহত্যার বিচার না করে বিদ্যমান কাঠামোয় ভোট দিলে ফ্যাসিবাদের ফের পুনরুত্থান ঘটতে পারে বলেও দলগুলোর নেতাদের দাবি। এ দাবি বাস্তবায়ন না হলে ইসলামী দল ও এনসিপির নির্বাচনে যাওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে।
বিকেপি/এমবি