একমি পেস্টিসাইডসের আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস!

এম এম হাসান
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:২১
-68c7be70d5b03.jpg)
গোঁজামিল তথ্য দিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন শেয়ার ইস্যু করে ২০২১ সালের ৩০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি একমি পেস্টিসাইডস লিমিটেড। এ (আইপিও) কোম্পানির বিরুদ্ধে গোঁজামিল তথ্য দিয়ে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের অর্থ মাধ্যমে উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
আর্থিক এই কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পাশাপাশি সংস্থাটির তদন্তে উঠে এসেছে, এ কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে মুনাফা, পরিচালন সক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপন করার পাশাপাশি পরিচালকের অবস্থান গোপন করার চেষ্টা করেছে। পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর ক্ষেত্রেও অনিয়মের শঙ্কা করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা কোনো অনিয়ম করেননি। এ বিষয়ে বিএসইসির কাছে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তারা। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে টাকা নিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে কোম্পানির অবস্থা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখায়। আর আইপিওর অর্থ হাতে পেয়ে গেলে কোম্পানির অবস্থা দুর্বল হতে থাকে। মূলত, তারা পুঁজিবাজারের অর্থ নিজেদের মনে করে লুটপাট করে।
বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, কোম্পানিটি ২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে (১৫ জুন থেকে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে) হঠাৎ করে পরিশোধিত মূলধন ৯৭শতাংশ বা ১০৫ কোটি টাকা বাড়িয়েছে, যা তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে সন্দেহের মনে হয়েছে। প্রসপেক্টাসে উল্লিখিত আইপিও পূর্ববর্তী ৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদনেও কোম্পানির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ও শেয়ারপ্রতি নগদ পরিচালন প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) তথ্যে গরমিল পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তারা।
কোম্পানিটি প্রসপেক্টাসের ৭৯নং পাতায় মোট পাঁচ হিসাব বছরে (২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০) ইপিএস দেখিয়েছে যথাক্রমে ১ টাকা ১০ পয়সা, ১ টাকা ৪১ পয়সা, ১ টাকা ৪৭ পয়সা, ২ টাকা ১৩ পয়সা এবং ২ টাকা। কিন্তু একই প্রসপেক্টাসের ২১৬নং পাতায় ওই পাঁচ হিসাব বছরের জন্য ইপিএস দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ৭৯ পয়সা, ১ টাকা ১ পয়সা, ১ টাকা ৫ পয়সা, ১ টাকা ৫৯ পয়সা এবং ১ টাকা ৮৫ পয়সা।
একইভাবে প্রসপেক্টাসের ৭৮নং পাতায় কোম্পানিটি ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ হিসাব বছরের জন্য এনওসিএফপিএস দেখিয়েছে যথাক্রমে ১ টাকা ৪৫ পয়সা, ২ টাকা, ১ টাকা ৯৭ পয়সা, ২ টাকা ৫৯ পয়সা এবং ২ টাকা ২৮ পয়সা। যেখানে একই প্রসপেক্টাসের ২১৬নং পাতায় এনওসিএফপিএস দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ১ টাকা ৪ পয়সা, ১ টাকা ৪৪ পয়সা, ১ টাকা ৪১ পয়সা, ১ টাকা ৯৪ পয়সা এবং ২ টাকা ১১ পয়সা। অর্থাৎ কোম্পানিটি একই প্রসপেক্টাসে দুই ধরনের তথ্য দিয়ে প্রকৃত তথ্য গোপনের চেষ্টা করেছে। এছাড়া প্রসপেক্টাসের ৯৬নং পাতায় কোম্পানিটি উল্লেখ করেছে, তাদের কোনো পরিচালকরা তালিকাভুক্ত অন্য কোনো কোম্পানি অথবা তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে বিগত তিন বছরের মধ্যে যুক্ত নেই। তবে একই প্রসপেক্টাসের ২২নং পাতায় কোম্পানিটি জানিয়েছে যে তাদের পর্ষদের স্বতন্ত্র পরিচালক অধ্যাপক এম শাহজাহান মিনা তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ব্যাংক এশিয়া সিকিউরিটিজ এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসইসি) পর্ষদে পরিচালক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। একই প্রসপেক্টাসে দুই ধরনের তথ্য দিয়ে কোম্পানিটি প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, কোম্পানিটি তাদের চূড়ান্ত আইপিও প্রসপেক্টাসে মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য দিয়ে এবং পর্ষদ পরিচালকের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন দেখিয়ে বিএসইসির পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর ধারা ১৫ লঙ্ঘন করেছে। বিএসইসি এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯ অনুসারে কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। বিএসইসির তদন্ত কর্মকর্তারা কোম্পানিটির আইপিও তহবিল ব্যবহারের চিত্রও পরিদর্শন করেছে। এতেও নানা ধরনের অনিয়ম পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে আইপিওর অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার, সময়মতো অর্থ ব্যয়ের নিরীক্ষিত প্রতিবেদন জমা না দেওয়া, নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ ব্যবহার শেষ করতে না পারা এবং পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে আইপিওর অর্থ থেকে ঋণ দেওয়ার মতো অনিয়ম পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এছাড়া এক আইপি এড্রেস ব্যবহারের মাধ্যমে হাজারের বেশি বিনিয়োগকারীর ভোট চুরি করে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা পাস করিয়ে নেওয়ারও প্রমাণ পেয়েছে বিএসইসি। চেক অথবা ব্যাংক লেনদেনের পরিবর্তে অধিক হারে নগদ লেনদেন করে আইন লঙ্ঘন করেছে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও ব্যয় বাড়িয়ে দেখানোর মতো অনিয়ম পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে বিএসইসির তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, আইপিও প্রসপেক্টাস এবং আইপিও সম্মতিপত্র অনুযায়ী প্রথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থে এফডিআর কিংবা অন্য কোনো কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার অনুমোদন নেই। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি আইপিও সম্মতিপত্র সংক্রান্ত শর্ত ৬নং এর 'সি' ধারা এবং বিএসইসি পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর ২১নং ধারা লঙ্ঘন করেছে। কোম্পানিটি বিপুল পরিমাণ অর্থ নগদ লেনদেন করে আইপিও সম্মতিপত্রের শর্ত ৫-এর 'সি' ধারা লঙ্ঘনের পাশাপাশি বিএসইসি পাবলিক ইস্যু রুলস ২১৫-এর ব্যত্যয় ঘটেছে।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে একমি পেস্টিসাইডসের কোম্পানি সচিব সবুজ কুমার ঘোষ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, 'আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আমরা বিএসইসিকে ব্যাখ্যা দিয়েছি।'
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, 'একমি পেস্টিসাইডসের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দীর্ঘদিন অনেক কোম্পানি আইপিও থেকে টাকা তুলে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে অনেক কোম্পানি। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি বাড়াতে হবে।'
বিএসইসির মুখপাত্র ও পরিচালক আবুল কালাম জানান, 'তদন্তে যে অনিয়ম ধরা পড়েছে, সেগুলো প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমিশন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত।'
বিকেপি/এমবি