সাত কলেজ নিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বৈরথে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

তরিকুল ইসলাম সুমন
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৮

- সোমবারের মধ্যে অধ্যাদেশ জারির সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি শিক্ষার্থীদের
- কলেজগুলোর জন্য প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা চান শিক্ষকরা
- শিক্ষা কার্যক্রম শুরু ২০৩১ সালে
- পুরো কার্যক্রমের ওপর নজরদারি চলছে : ইউজিসি
- ইডেন ও তিতুমীর কলেজেও উচ্চ মাধ্যমিক চালুর প্রস্তাব
রাজধানীর সাত কলেজ সমন্বয়ে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির (ডিসিইউ) নিয়ে ত্রিমুখী অবস্থানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। একদিকে কলেজগুলো কলেজিয়েট বা অধিভুক্তমূলক কাঠামোয় রূপান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃথক ক্যাম্পাসে স্থাপন করে সাতটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় করার বিষয়টি নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছেন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত অধ্যাদেশ জারি করা, উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা কলেজ অক্ষুণ্ণ রাখার দাবিতেও নানা কর্মসূচি পালন করছে। ফলে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে সাত কলেজের দুই লাখ শিক্ষার্থী ও এক হাজারের বেশি শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলনরত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আগামীকাল সোমবারের মধ্যে অধ্যাদেশ জারির সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। না হলে ফের রাজপথে 'কঠোরভাবে' নামার হুমকি দিয়েছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছে। কিন্তু কখনো শিক্ষকরা (সাত কলেজের) তাদের পাশে ছিল না।
ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুর রহমান বলেন, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ করতে কতক্ষণ সময় লাগবে সেটি সোমবারের মধ্যে অবশ্যই স্পষ্ট করতে হবে। তা না করলে বড় আকারে আন্দোলনে যাবেন। সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় অভিমুখে যেতে পারে বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, 'শিক্ষকদের শিক্ষা ক্যাডারের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। তারা বছরের পর বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে সাত কলেজে থেকে গেছেন। আমরা গুণগতমানের বিকাশ চাই। শিক্ষক শব্দের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান নয়। এই ক্যাম্পাসে উচ্চ-মাধ্যমিক সক্রিয়তা বজায় রেখে উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।'
এর আগে গত বুধবার সাতটি সরকারি কলেজের কয়েকশ' শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সামনে মানববন্ধন করে কলেজগুলোর জন্য প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তারা ইউজিসির চেয়ারম্যানের কাছে একটি স্মারকলিপিও দেন। সাত কলেজের শিক্ষকদের আশঙ্কা, স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বাস্তবায়িত হলে কলেজগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতির মুখে পড়বে। শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ কমে যাবে, উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর বন্ধ হয়ে যাবে, শিক্ষকদের পদ-পদবি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হবে। বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজে নারী শিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেওয়ার পরিবর্তে পৃথক ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো) স্থাপন করে কলেজগুলোকে এর অধিভুক্ত করা উচিত বলে স্মারকলিপিতে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। তারা কলেজগুলোর ঐতিহ্য বজায় রেখে বর্তমান ব্যবস্থা বহাল রাখারও দাবি জানিয়েছে। তবে নাম 'ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়' থাকলেও আপত্তি নেই শিক্ষকদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা ক্যাডারের একজন অধ্যাপক বলেন, যারা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে তারা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে। যারা পারেনি তারা তাদের তুলনায় কম মেধাবী তাই তারা কলেজে অনার্স পড়ছে। তাদের কলেজে অনার্স পড়ার জন্য কেউ বাধ্য করেনি। এখন তারা যদি শুধু আন্দোলনের মাধ্যমে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পারে তাহলে এই ধারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। সবাই জেলা পর্যায়ের সব কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের আন্দোলন করে সহজ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যাবে। কিন্তু সরকারের পক্ষে কি তা করা সহজ বা আদৌ সম্ভব? এভাবে
বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিণাম কী হতে পারে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি?
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, 'সাত কলেজ নিয়ে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি ভিন্ন ধারার। ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও তাগিদ রয়েছে। সব উদ্যোগের সঙ্গে সাত কলেজের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। একটি স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়নে একটি নজরদারি সংস্থা কাজ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, ঢাকার সরকারি সাত কলেজ পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় বা সমকক্ষ হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন অধ্যক্ষের নেতৃত্বে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে আর পুরো কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করবেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একজন সদস্য।'
ইউজিসির উপপরিচালক (পাবলিক ইউনিভার্সিটি) জামাল উদ্দিন বলেন, ইউজিসির 'ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি' এর আইন নিয়ে কাজ করবে। এরপর সংসদে এ আইন পাস করে তবেই বিশ্ববিদ্যালয়। পুরো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে ২০৩১ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, সরকারি সাত কলেজকে নিয়ে নতুন ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (ডিসিইউ)। শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ২৮টি টিম গঠন করা হয়েছে। এই ২৮টি টিম নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মতামত দিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কাঠামো হবে, সেটার একটি রূপরেখা তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী প্রশাসকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে সরকার এবিষয়ে আন্তরিক।
সাত কলেজের জন্য গঠিত সমন্বিত কাঠামোর অন্তর্বর্তী প্রশাসক ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ একেএম ইলিয়াস বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় করার বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি কাজ করছে। বর্তমানে উচ্চ-মাধ্যমিক না থাকা ইডেন মহিলা কলেজ এবং তিতুমীর কলেজে উচ্চ-মাধ্যমিক চালু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে অধ্যক্ষ বলেন, তারা চান কলেজগুলোতে উচ্চ-মাধ্যমিক এবং শিক্ষকদের পদগুলো অক্ষন্ন রেখেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টি হোক।
সাতটি কলেজ হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ। ২০১৭ সালে এসব কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। তবে নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডিসিইউ) এখনকার মতো এসব কলেজে সব বিষয় পড়ানো হবে না। সাতটি কলেজকে চারটি স্কুলে (অনুষদ) বিভক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে স্কুল অব সায়েন্স ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদররুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাস নির্ধারিত থাকবে; স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিসের জন্য সরকারি বাঙলা কলেজ এবং স্কুল অব বিজনেসের জন্য সরকারি তিতুমীর কলেজ নির্ধারিত থাকবে; স্কুল অব ল' অ্যান্ড জাস্টিসের জন্য কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ক্যাম্পাস নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ শতাংশ ক্লাস অনলাইনে এবং ৬০ শতাংশ ক্লাস হবে সশরীরে। তবে সব ধরনের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে সশরীরে।
ইউজিসি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী ২০৩১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই নাম চূড়ান্ত হলেও ২০৩১ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অধীনে স্বতন্ত্র নজরদারি সংস্থা কাঠামো থেকে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে সাত কলেজ। এদিকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির মূল ক্যাম্পাস কোথায় হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জানা গেছে, তিতুমীর কলেজে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস হতে পারে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে এই সাত কলেজে শিক্ষার্থী দুই লাখ। শিক্ষক এক হাজারের বেশি। ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা হচ্ছে কলেজগুলোর ঐতিহ্যকে ধারণ করেই। সাত কলেজের যে পাঁচটিতে ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার্থী ছিল সেটি তেমনই থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু কলেজের সময় ও জায়গা শেয়ার করবে। এতে ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার্থী ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষকদের অবস্থান একই থাকবে। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি হবে নতুন মডেলের বিশ্ববিদ্যালয়।
বিকেপি/এমবি