উৎসবের রঙে রঙিন শাঁখারিবাজারের দুর্গোৎসব
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১৮:৪৮
---2025-10-01T184729-68dd23131fa1c.jpg)
ছবি : বাংলাদেশের খবর
পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্র শাঁখারিবাজার। প্রায় চারশো বছরের পুরোনো এই এলাকায় দুর্গাপূজা মানেই রঙিন উৎসব, আড্ডা, আনন্দ আর মিলনমেলা। নবমীর দিনে এসে সেই আনন্দ যেন চূড়ান্ত রূপ নেয়। গলির পর গলি, ঘরে ঘরে আর প্রতিটি মণ্ডপে সেজেছে আলো, রঙ আর ঢাকের বাদ্যে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই উৎসব ঘিরে শাঁখারিবাজার এখন সত্যিকার অর্থেই উৎসবের নগরী।
শাঁখারিবাজারের প্রতিটি মন্দির ও পূজা মণ্ডপে সকাল থেকেই ভক্তদের ভিড়। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়স্করা হাতে ফুল, ধূপ, আরতি নিয়ে দেবীর আরাধনায় অংশ নেন। নবমীর বিশেষ পূজা উপলক্ষে পুরোহিতরা শাস্ত্রপাঠ ও মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে দেবীর চরণে প্রসাদ নিবেদন করেন। ভক্তদের বিশ্বাস, এ দিনে আন্তরিক প্রার্থনা করলে দেবী দুর্গা অশুভ শক্তি বিনাশ করে সংসারে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনবেন।
গলির ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে উজ্জ্বল আলোকসজ্জা ও সাজানো প্রতিমা। ঢাক-ঢোল, শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে মুহূর্তেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। শিশু-কিশোররা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে। হাতে রঙিন বেলুন, মুখে কটন ক্যান্ডির রং, আবার কেউবা মেলা থেকে কেনা খেলনা নিয়ে মেতে উঠেছে। বয়স্করা ব্যস্ত আত্মীয়-স্বজন ও পুরোনো প্রতিবেশীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ে। দুর্গাপূজা তাই শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এক সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে পুরান শহরে।
নবমীর দিনে বসে ঐতিহ্যবাহী মেলা। গলির দুই পাশে সারি সারি দোকান-যেখানে পাওয়া যাচ্ছে পিঠা-পায়েস, জিলাপি, নকশি মুরালি, খেলনা, শাঁখা-চুড়ি, মাটির পুতুলসহ নানা সামগ্রী। শিশুদের ভিড়ে সরগরম দোকানগুলো। অনেকে পূজা শেষে মেলায় ঘুরে প্রিয়জনের জন্য স্মারকও সংগ্রহ করছেন।
ঢাকার অন্যতম প্রাচীন পূজা হিসেবে শাঁখারিবাজারের দুর্গোৎসবের রয়েছে আলাদা ঐতিহ্য। স্থানীয় প্রবীণরা জানান, একসময় এ এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই শাঁখা-চুড়ির ব্যবসা ছিল। সেই সূত্রেই দুর্গোৎসব এখানে আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। পূজার দিনগুলোতে ঢাকার বাইরের অসংখ্য মানুষও ভিড় করেন এখানে। বিভিন্ন জেলা থেকে আত্মীয়দের কাছে বেড়াতে আসা হিন্দু পরিবারগুলোও উৎসবে শরিক হন।
পূজার নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবীরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিটি মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে ভক্তরা নির্বিঘ্নে আনন্দে পূজা-অর্চনা ও মেলায় অংশ নিতে পারছেন।
নবমীর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ আরতি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ঢোল, কীর্তন আর গানের সুরে মুখর হয়ে ওঠে শাঁখারিবাজার। স্থানীয় তরুণ-তরুণীরা নাচ-গান পরিবেশন করে পরিবেশকে আরও আনন্দঘন করে তোলে। আরতির সময় শঙ্খধ্বনি ও ঢাকের বাদ্যে ভক্তরা হাত জোড় করে দেবীর চরণে প্রণতি জানান।
শাঁখারিবাজারের দুর্গোৎসব এখন আর শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এক সমন্বিত সংস্কৃতির প্রতীক। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অনেকেই এদিন মণ্ডপে আসেন। মুসলিম প্রতিবেশীরাও বন্ধু-পরিজনদের সঙ্গে মেলা ঘুরে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। পূজা উপলক্ষে শাঁখারিবাজার হয়ে ওঠে এক মহা মিলনমেলা।
নবমীর দিনে এমন উচ্ছ্বাস ও আনন্দে ভরপুর শাঁখারিবাজার দেখে স্থানীয় এক তরুণী আবেগঘন কণ্ঠে বললেন, ‘দুর্গাপূজা শুধু পূজা নয়, এটি আমাদের শিকড়, আমাদের ঐতিহ্য। নবমীর রাতে যখন আলোয় আলোকিত হয় শাঁখারিবাজার, মনে হয় গোটা পৃথিবী আনন্দে মেতে উঠেছে।’
- এমআই