Logo

বিশেষ সংবাদ

ভাড়া করা জাহাজে চলবে টুনা গবেষণা

Icon

তরিকুল ইসলাম সুমন

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৪৭

ভাড়া করা জাহাজে চলবে টুনা গবেষণা
  • পেলাজিক মাছ আহরণে ২৮ জাহাজের অনুমোদন 
  • প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হবে টুনা ধরার মাস্টার প্ল্যান
  • জাহাজ সরবরাহে প্রতারণায় ৫২ লাখ টাকা জরিমানা আদায়
  • টুনা আহরণে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব
  • পযাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকায় সাড়া মেলেনি বিনিয়োগকারীদের

বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমার গভীরতর অংশে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে টুনা মাছের মজুদ এবং এ জাতীয় মাছ আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিদেশে রপ্তানির কলাকৌশল পরীক্ষণে জটিলতা কাটতে চলেছে। মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্প শুরুর পর প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও নানা জটিলতায় জাহাজ কেনার পরিবর্তে ভাড়া করা জাহাজ দিয়ে চলবে গবেষণা।

প্রকল্প সূত্র জানায়, গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে পাইলট প্রকল্প (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় দুটি জলযান (ফিশিং ভেসেল) কিনতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউনি মেরিন সার্ভিসেস পিটিই লিমিটেড, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে চুক্তি করে, কিন্তু করোনা মহামারির কারণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি না পাওয়ায় ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ১৯ লাখ ২৪ হাজার মার্কিন ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়। 

সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ৩০ জুন, ২০২৪-এর মধ্যে দুটি জলযান সরবরাহের কথা থাকলেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রতারণামূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর চুক্তিটি বাতিল করে প্রায় ৫২ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। পাশাপাশি দুই বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এ কারণে টুনা আহরণের জলযান দুটি ক্রয় করা সম্ভব হয়নি।

প্রকল্প সূত্র আরো জানায়, টুনার অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি জলযান ক্রয়ের পরিবর্তে ২টি লং-লাইনার প্রকৃতির জলযান ভাড়া নিয়ে বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমার গভীরতর অংশে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণ ও গবেষণার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গত ১১ আগস্ট প্রকল্পটির মেয়াদ ৩০ জুন ২০২৭ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে এবং প্রাক্কলিত ব্যয় ৪১.৪৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করে এর ২য় সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন করে।

গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ ও সমজাতীয় পেলজিক মাছ আহরণে পাইলট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. জুবায়দুল আলম বলেন, প্রকল্পটির ২য় সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশে টেকসই ও অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর টুনা ফিশিং শিল্প বিকাশের জন্য সমীক্ষা এবং মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি ২টি লং-লাইনার প্রকৃতির টুনা ভেসেল ভাড়াপূর্বক সেপ্টেম্বর ২০২৬ হতে মার্চ ২০২৭ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় ১২টি ক্রুজ পরিচালনার মাধ্যমে সরেজমিনে জরিপ করে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছের প্রাপ্যতা যাচাই, মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন, ক্রুসহ টুনা আহরণে নিয়োজিত ব্যক্তিদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। ইতোমধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে এবং চলতি মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত আগ্রহীদের প্রস্তাব জমাদানের জন্য সময় নির্ধারিত রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রাপ্ত প্রস্তাবসমূহ মূল্যায়ন শেষে চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে গবেষণার কাজ শুরু করতে চান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর ও বিশেষজ্ঞরা জানান, টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণ এবং এর প্রাপ্যতা যাচাইয়ের জন্য গবেষণাধর্মী এ প্রকল্পটি ২০২০ সালের আগস্ট মাসে গ্রহণ করা হলেও করোনা মহামারি, মার্কিন ডলারের সংকট এবং সর্বোপরি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রতারণামূলক কাজে জড়িত থাকায় প্রায় ৫ বছর শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে ভাড়ায় নিয়ে আসা জাহাজ দিয়েই করা হবে গবেষণা। 

প্রকল্প শুরুর পূর্বে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং জাপানের সঙ্গে টুনা মাছ আহরণ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে সম্মত হয়নি, এখন ভাড়ায় জাহাজ এনে আগামী মৌসুম (সেপ্টেম্বর-নভেম্বরের ২০২৬) থেকে বিস্তারিত সমীক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে চাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের জলসীমায় সেপ্টেম্বরে থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত টুনা মাছের প্রাচুর্য বেশি থাকে এবং অন্য সময় উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় টুনাজাতীয় মাছ পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরতে লং-লাইনার ও পার্স-সেইনার ধরনের জাহাজের প্রয়োজন হয় এবং এ ধরনের জাহাজ বাংলাদেশে একটিও নেই।

মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক জানান, বঙ্গোপসাগরে বিশাল এলাকার একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইজেড) জলসম্পদের মালিক হলেও আমাদের এই জলসীমায় টুনা মাছের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। দেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকার কার ঠিক বাইরে, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের আশপাশে টুনা মাছের প্রাপ্যতা বেশি পৃথিবীর কোনো দেশেই টুনা নিয়ে পূণাঙ্গ জরিপ নেই, তবে দু-একটি দেশের কাছে টুনা কোন কোন আঞ্চলে পাওয়া যায় তার তথ্য রয়েছে।

সূত্র জানায়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৮টি লং-লাইনার, ৮টি পার্স সেইনার এবং ২টি সহায়তাকারী জাহাজ আমদানী অথবা স্থানীয়ভাবে তৈরির জন্য সম্মতি দেয়। কিন্তু টুনা মাছের মজুদ সম্পর্কিত পযাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এবং টুনা আহরণে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল না থাকায় বেসরকারি খাতের কেউ এখন পর্যন্ত এগিয়ে আসেনি।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) সদস্যপদ পেয়েছে বাংলাদেশ। আইওটিসির সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলসীমায় (বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায়) মাছ ধরার অধিকার পেয়েছে। তবে আইওটিসির সদস্যদেশ হিসেবে সংস্থাটিকে প্রতিবছর বাংলাদেশকে প্রায় ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (প্রায় ৮৫ লাখ টাকা) চাঁদা দিতে হয়। আইওটিসির সদস্যপদ পাওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোন দেশ কত মাছ ধরছে, কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে এ ধরনের তথ্য-উপাত্ত পেয়ে থাকে বাংলাদেশ।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশের জলসীমার ২০ শতাংশ উপকূলীয়, ৩৫ ভাগ অগভীর সাগর ও ৪৫ ভাগ গভীর সাগর এলাকা। বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের জলসীমা, এরপর থেকে আন্তর্জাতিক জলসীমা শুরু, যাকে গভীর সাগর হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। দেশের জাহাজগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমায় গিয়ে মাছ ধরে না।

মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ২৩০টি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে মৎস্য আহরণ করে থাকে। বাংলাদেশের উপকূল এলাকা এবং অগভীর সাগরে প্রায় ৩০ হাজার মাছ ধরার নৌকা (আর্টিসনাল বোট) রয়েছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক সম্পদের অনুসন্ধান পরিচালনা সংক্রান্ত জরিপ কাজের জন্য ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও মালয়েশিয়া সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের আওতায় গবেষণা জাহাজ আরভি মিন সন্ধানী মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং ২০১৬ সালের ১৯ নভেম্বর জরিপ জাহাজটি কমিশনিং লাভ করে।

বিকেপি/এমবি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর