
- ধরাছোঁয়ার বাইরে লোপাটকারীরা
- জালিয়াতিতে বাধ্য করা হয়েছে কিনা, বিবেচনা করতে হবে : বাংলাদেশ ব্যাংক
- নথিপত্র যাচাই করে আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে দুদক : মহাপরিচালক
- নিরীহ ব্যাংকারকে ডাকছে দুদক
আনিসুজ্জামান, মার্জারের বিবেচনায় থাকা এক্সিম ব্যাংকের কর্মী। ব্যাংকটির একটি জালিয়াতির ঋণ প্রক্রিয়ায় সই করেন। ব্যাংকটির বিতর্কিত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাকে নিরুপায় হয়ে এতে সম্পৃক্ত হতে হয়। সুবিধাভোগী না হলেও, এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের জালে পড়েছেন তিনি।
কেবল আনিসুজ্জামান নন, কিংবা এক্সিম ব্যাংকের ঘটনা এমন নয়। বিগত সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাতে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, লোপাট হয়েছে এসব প্রক্রিয়ায় শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়, সব স্তরে অনেক নিরীহ কর্মী এখন দুদকের নথিতে অপরাধী। অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হচ্ছে।
সূত্রগুলো বলছে, ব্যাংক ডাকাতদের দায়ভার পড়ছে নিরীহ কর্মকর্তাদের ঘাড়ে। অথচ ধরাছোঁয়ার বাইরে ব্যাংকিং খাত যারা ডুবিয়েছেন এমন অনেকে। কিন্তু আদালত কিংবা দুদকে দৌড়ঝাঁপ করতে দিন পার করতে হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপ ৩৮ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয়। নামে-বেনামে ভুয়া নথিপত্রে তৈরি করা হয় ঋণগুলো। এমনকি কাজের লোকের নামেও ঋণ তৈরি করে এস আলম গ্রুপ। ইউনিয়ন ব্যাংকের ২৮ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে গ্রুপটি। ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল অর্থ বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। আর তার ঋণ কেলেংকারির দায় এখন সাধারণ ব্যাংকারদের অনেককে বহন করতে হচ্ছে। ফলে ফাঁসতে হচ্ছে নিরীহ অনেক ব্যাংকারকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত দিনে চাকরি ও হয়রানির ভয় দেখিয়ে জাল-জালিয়াতির ঋণ প্রস্তাবে স্বাক্ষর নেওয়া হয় অনেকের কাছ থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়, এমনকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জড়িয়ে পড়ে এসব অপকর্মে। আর মৌখিক নির্দেশে সংঘটিত হয়েছে সব অনিয়ম, যার প্রমাণ রাখেনি ব্যাংক লুটেরা চক্র।
অর্থনীতিবিদ ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেন, 'যারা অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি হোক, তবে নিরপরাধ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে। সারা জীবন সততার সঙ্গে কাজ করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু এখন তাদের দুদকে ডাক পড়ছে। আর নিজের উপার্জন থেকে মেটাতে হচ্ছে মামলার খরচও।'
জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, 'দুদক আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট যেসব অভিযোগ পেয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করে থাকে। কেবল যাদের বিরুদ্ধে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এখানে অহেতুক হয়রানির সুযোগ নেই।'
তবে ব্যাংকের পর্ষদ আর শীর্ষ নির্বাহী দায়মুক্ত পাচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নে আক্তার হোসেন বলেন, 'ঋণ অনুমোদন থেকে প্রস্তাব প্রেরণকারী ও অনুমোদনকারী কমিটি ও পর্ষদ, যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।'
অনুসন্ধান বলছে, ব্যাংক ডাকাতির ঋণের নথিতে স্বাক্ষর না করলেও গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়েও নিয়ে যাওয়া হয় বিগত সরকারের আমলে। সাদা স্ট্যাম্পে সই নেওয়া হতো। চাকরি হারিয়ে পরিবার-পরিজনের কথা চিন্তা আর জীবনের নিরাপত্তায় অনেক অপকর্মে সম্পৃক্ত হতে হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, 'বিগত দিনে আইন না মানার প্রবণতা ছিল সরকারের অনেক খাতে। ব্যাংকিং খাতেও তাই হয়েছে। ফলে নীতিমালা মেনে ব্যাংকিং কাজ করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এখন সেগুলো সামনে আসতে শুরু করেছে।
তিনি আরও বলেন, কর্মীরা বাধ্য হয়ে সই করেছেন কিনা সেটি চিন্তায় রাখতে হবে। অন্যথায় সংকট তৈরি হবে। এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না, যাতে মেধাবীরা এই পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের এই পচনে বিগত দিনে সমর্থন দিয়ে গেছে খোদ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক। তদারকির পরিবের্তে, আতাত করেছে অর্থ লোপাটে। যদিও শক্ত কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যায়নি।
দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র মতে, এসআইবিএল, এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটিসহ বেসরকারি খাতের কয়েকশ কর্মী এখন বিপদে আছেন। যারা হয়তো জালিয়াতির কোনো ফায়দা পাননি। জনতা, রূপালীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোরও একই চিত্র। ফলে ব্যাংক খাতে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন কর্মীরা কেউ সাধারণ ও জরুরি ফাইলেও সই করতে সাহস করছেন না, যা অর্থনীতির জন্য স্বস্তির নয়।
দুদক বলছে, এটা ঠিক, অনেক নিরপরাধ ব্যাংকার আইনের আওতায় আসছে, কিন্তু বিদ্যমান আইনি কাঠামোর কারণে কিছু করার নেই সংস্থাটির। তবে, বিষয়টি উদ্বেগজনক।
এ ব্যাপারে সাবেক ব্যাংকার আরফান আলী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ব্যাংকাররা অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, পুরো খাতে একটি আতংক তৈরি হয়েছে। যারা অপরাধ করেছেন, জালিয়াতির সুবিধা নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ সবাই সমর্থন করবে। কিন্তু একজন নিরীহ ব্যাংকার যদিও আক্রান্ত হন, সেটিও দুঃখজনক হবে। আমি সুপারিশ করবো, সরকারের সংস্থাগুলো এখানে সতর্ক থাকবে।
বিকেপি/এমবি